যাঁরা ভাবছেন যে আমরা না ভেবে-চিন্তে কথা বলছি, তাঁদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি শুরুতেই। পাঠকদের মধ্যে অনেকেই থাকবেন যাঁদের ছেলেপুলেরা ইংরেজি মাধ্যমে পড়েও নিশ্চিতভাবেই মহা আনন্দে বাংলা পড়ে, তরতরিয়ে নির্ভুল বানানে মনের কথা লেখে – বাবা-মা হিসেবে তাঁদের অভিনন্দন!
সমস্যা হল, এর বাইরেও বহু বহু অভিভাবক আছেন। বিশেষ করে যাঁদের সন্তান ইংরেজি মাধ্যমে পড়েছে ছোটো থেকেই এবং পড়াশোনায় মাঝারিমানের, তারা বাংলায় রীতিমতো হোঁচট খায়। কিছু মা-বাবা তা নিয়ে গর্ব করলেও অনেকেই মেনে নিতে পারেন না সন্তানের এই খামতি। একটা সময়ে যাঁরা ভেবেছিলেন, ইংরেজি না শিখলে ছেলেকে প্রতিষ্ঠিত করাই যাবে না, পরে তাকেই কুঁতিয়ে কুঁতিয়ে বাংলা পড়তে দেখে তাঁদেরও খারাপ লাগেই – তাই না?
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছাত্র বা ছাত্রীটির উপর চাপিয়ে দেওয়া হয় এর দায়, স্কুলে-বাড়িতে বকাঝকা খেতে খেতে সে বেচারাও ভাষার থেকে ক্রমশ দূরে সরতে থাকে। একটা সময় লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় কোনওক্রমে বারো ক্লাস উতরে দেওয়া, তার পর তো জন্মের মতো আড়িই হয়ে যায় মাতৃভাষার সঙ্গে! কথা বললেও লেখা বা পড়ার সঙ্গে বন্ধুতা হয় না, মুখের ভাষাও সাবলীলতা হারিয়ে হয়ে দাঁড়ায় জগাখিচুড়ি।
আমরা কেউ তার পাশে দাঁড়াই না, ভাবি না যে এই ব্যর্থতা আমার-আপনার-শিক্ষাব্যবস্থার নয় তো? যার দিকে আঙুল উঠছে, তাকে ভাষাটা শেখাতে পারিনি আমরাই — এই সহজ সত্যিটা যতই আড়ালে ঠেকে দিই না কেন, সেটাকে অস্বীকার কি করা যায়?
কেন মাতৃভাষার সঙ্গে বৈরিতা জন্মায়?
যে কোনও ভাষা শেখার জন্য সেই ভাষাটা শোনা জরুরি। যাঁরা বাংলা মাধ্যম ইশকুলে পড়েও নিজের চেষ্টায় ইংরিজি শিখেছেন এবং ঝরঝরিয়ে বলতে পারেন, বা ইংরেজি প্রথম ভাষা হলেও বাংলা শিখেছেন যত্ন করে — তাঁরা নিশ্চয়ই এ কথা মানেন? বিশেষ করে ভালো লিখতে পারার জন্য সেই ভাষায় পড়া জরুরি। যারা ভাষাটা ভালো করে আয়ত্ব করতে পারে না, তাদের বেশিরভাগেরই গল্পের বই সম্পর্কে আগ্রহ থাকে না।
বাংলা বইয়ের সঙ্গে পরিচয় করান
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ইংরিজি শেখানোর জন্য স্কুলে বাচ্চাদের সঙ্গে দিদিমণিরা ইংরেজি বলেন। তারা কবিতা-ছড়াও শেখে সে ভাষাতেই, বাবা-মা বাচ্চার পড়ার জন্য বড়ো হরফে লেখা চমৎকার সব ছবির বই কিনে আনেন। বাংলা বইয়ের ক্ষেত্রে তেমনটা করেন কী? একেবারে গোড়া থেকেই শুরু করা দরকার। একটু খুঁজলেই এ ধরনের বই মিলবে বাজারে।
বাচ্চারা গল্প শুনতে ভালোবাসে, সেটা খেয়াল রাখবেন
গল্প শুনতে কার না ভালো লাগে? শিশুরা সভ্যতার শুরুর দিনগুলো থেকেই গল্প শুনতে পেলে কিছু চায় না। কিন্তু এখন না আছে দাদু-ঠাকুমার সময়, না বাবা-মা বাড়িতে থাকেন। ফলে শিশু বড়ো হয় মোবাইলে বা টিভিতে কার্টুন দেখতে দেখতে। এই অভ্যেস তাড়ানোর উপায় একটাই – তাকে গল্প পড়ে শোনান। একটু বড়ো হলে খানিকটা নিজে পড়ুন, বাকিটা তাকে পড়ে শোনাতে বলুন। এতে পড়ার অভ্যেস তৈরি হবে।
অডিও-ভিস্যুয়ালের সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য তৈরি থাকুন
অডিও-ভিস্যুয়াল অত্যন্ত শক্তিশালী মাধ্যম, তাই টিভি বা ডিজিটাল মিডিয়ার সঙ্গে একবার পাকাপাকি সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেলে কিন্তু ফিরিয়ে আনা মুশকিল হবে। তাই রোজ একটা সময় করে বসুন সন্তানের সঙ্গে। খুঁজে খুঁজে ভালো বই বের করুন, এমন জিনিস পড়তে দিন যাতে সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়।
এই টোটকার কোনওটাই কাজে লাগল না, এমনও হতে পারে কিন্তু! কিছু মানুষের সাহিত্যের প্রতি আলাদা টান গড়ে ওঠে না – সেক্ষেত্রে সন্তানকে বোঝাতে হবে যে মাতৃভাষা ভালো করে না জানলে সে কোনওভাবেই নিজের মনের ভাব ফুটিয়ে তুলতে পারবে না পরবর্তীকালে। সেটাও নিশ্চয়ই অভিপ্রেত নয়?
সোজা কথায় – চেষ্টা ছাড়বেন না। আপনি লেগে থাকলে আপনার সন্তানও একদিন না একদিন ভাষায় সঙ্গে বন্ধুত্ব করেই ফেলবে!