মানুষ বরাবরের মতো চলে যাওয়ার পর আর বিশেষ কিছু বলার থাকে না, পড়ে থাকে কেবল টুকরো কিছু স্মৃতি। গত দুইদিনে দু’জন শিল্পীর চলে যাওয়ায় একটু নাড়া খেয়েছে বাংলার সংস্কৃতিমহল, শোকের অভিঘাত পুরো সামলে ওঠা সম্ভব হয়নি এখনও।
প্রথমে গেলেন তবলিয়া শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। ২৫ তারিখ। পণ্ডিত রবিশঙ্কর, উস্তাদ আমজাদ আলি খান, অজয় চক্রবর্তী, রাশিদ খান – এমন কেউ নেই যাঁর সঙ্গে সঙ্গত করেননি মাঝ পঞ্চাশের হাসিখুশি শুভঙ্কর। তাঁর অনন্য স্টাইল আর নিরহঙ্কার ব্যবহারের জন্য সবার প্রিয় ছিলেন।
মায়ের স্মৃতিতে প্রতি বছর এ শহরে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আসর বসাতেন তিনি, তাতে বাজিয়ে গিয়েছেন দিকপালরা। ২০২০ –র জানুয়ারিতেই তো তাঁর আমন্ত্রণে শহরে বাজিয়ে গিয়েছেন উস্তাদ জাকির হুসেন। ২০১৯ –এ উস্তাদ আল্লারাখার শতবর্ষে জাকিরের অন্য ভাইদের সঙ্গে এক মঞ্চে বাজিয়েছেন স্বপন শিবের এই ছাত্র।
জুন মাসে কোভিড আক্রান্ত হন শুভঙ্কর, দু’টি ভ্যাকসিন নেওয়ার পরেও রোগ অতি জটিল অবস্থায় পৌঁছয়। টানা মাস দুয়েক ভর্তি ছিলেন নার্সিংহোমে, দীর্ঘদিন রাখা হয়েছিল একমো সাপোর্টে — তার পরেও অবস্থা শুধরোয়নি। স্ত্রী-পুত্র-কন্যা-বন্ধুবান্ধব তো বটেই, দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা তাঁর অজস্র ছাত্রের কাছেও শুভঙ্করের মৃত্যুটা খুব বড়ো ধাক্কা।
আবৃত্তিকার গৌরী ঘোষ চলে গেলেন ২৬ তারিখ সকালে। বার্ধক্যজনিত নানা অসুবিধেয় ভুগছিলেন দীর্ঘদিন, ১ তারিখ থেকে ভর্তি ছিলেন হাসপাতালেই। শেষ কিছুদিন ভেন্টিলেশনেও রাখা হয়েছিল – তবে আর সাড়া মেলেনি। সকাল ৯টার আশে-পাশের কোনও একটা সময়ে প্রয়াত হন ৮০ পেরনো এই বাচিক শিল্পী-উপস্থাপিকা।
রেডিও যাদের ছেলেবেলার অনেকটা সময় জুড়ে আছে, তাঁরা গৌরী ঘোষের কণ্ঠস্বর আর উচ্চারণের মায়াজাল এ জীবনে কাটিয়ে উঠতে পারবেন না। তাঁর গলা থেকে একদিকে যেমন ঝরে পড়ত আভিজাত্য, তেমনই আবার লগ্ন হয়ে থাকত ঋজু দৃঢ়তা। বাংলা ভাষা যেভাবে তাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত হত, তার তুলনা নেই।
স্বামী পার্থ ঘোষের সঙ্গে একটা দীর্ঘ সময় আকাশবাণী কলকাতার উপস্থাপিকার কাজ করেছেন, তাঁদের একাধিক ডুয়েট আবৃত্তি ও শ্রুতিনাটক প্রবাদপ্রতিম জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। বিশেষ করে ‘কর্ণকুন্তীসংবাদ’ ভোলা মুশকিল। অভিনয় করেছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ পরিচালিত ‘অসুখ’ ছবিতে, পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাজী সব্যসাচী পুরস্কার। গৌরী ঘোষের প্রয়াণে শোকজ্ঞাপন করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, বলেছেন তাঁর প্রয়াণে বাংলার সংস্কৃতি জগতের বিরাট বড়ো ক্ষতি হয়ে গেল।
একটা কথা স্বীকার করতেই হবে – রেডিও-র আড়ালে থাকা এই মানুষগুলো একটা সময়ে ছিলেন সত্যিকারের তারকা, শ্রোতারা মুগ্ধ হতেন তাঁদের গ্ল্যামারের ছটায়। কিন্তু যাঁরা কখনও গৌরী ঘোষের ধারে-কাছেও গিয়েছেন, তাঁরাই জানেন অমন নরম মনের উষ্ণ মানুষ দু’টি হয় না। চূড়ান্ত সাফল্য পেয়েও মাটির কাছাকাছি থাকার যে দুরূহ কলা রপ্ত করেছিলেন এঁরা, তা সত্যিই পরবর্তী প্রজন্মের ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাবে চিরটাকাল।