মাতৃত্বের সঙ্গে ত্যাগ, মহত্ব ইত্যাদি আদর্শকে এমনভাবে জুড়ে দেওয়া হয়েছে যে মা হওয়ার পরেও একটি মেয়ে আসলে মানুষই থাকে, তার নিজের কিছু শখ আহ্লাদ থাকতে পারে – এসব সহজ কথা কারও মাথাতেই আসে না!
কিন্তু সময় বদলেছে, যুগ পালটেছে এবং মেয়েরা আর ঘরের চার দেওয়ালের ঘেরাটোপে আটকা পড়ে নেই একেবারেই! তারা বাইরে বেরোয়, পাঁচজনের সঙ্গে মেলামেশা করে এবং নিজের ও সন্তানের রক্ষণাবেক্ষণের উপযুক্ত অর্থ উপার্জনেও কোনওভাবে পুরুষের চেয়ে পিছিয়ে নেই। এই অবস্থায় বিয়ে টিকিয়ে রাখতে সমস্যা হলে, বা অন্য কারও সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লেও মা হিসেবে তার কোনও চ্যুতি হয় না – সন্তানের দেখভালেও তার কোনও প্রভাব পড়ে না।
সাম্প্রতিক একটি মামলায় এই চাঞ্চল্যকর রায় দিয়েছেন পাঞ্জাব ও হরিয়ানা হাইকোর্টের বিচারপতি অনুপেন্দর সিং গ্রেওয়াল। এই মামলায় আবেদনকারী অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক, পেশাগতভাবে যথেষ্ট প্রতিষ্ঠিত এবং তাঁর সন্তানের জন্ম অস্ট্রেলিয়ায়। ২০১৯ সালে স্বামীর সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় তিনি বিচ্ছেদের মামলা করেন সেখানকার আদালতে।
স্বামী কথা দিয়েছিলেন তিনি নিজেকে বদলানোর চেষ্টা করবেন, তাই তখন ডিভোর্স মুলতুবি হয়ে যায়। ২০২০ সালে যখন এই দম্পতি কন্যাসহ আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করতে ভারতে এসেছিলেন, তখন পাসপোর্টসহ মেয়েকে আটকে রেখে দেন স্বামী। তার পরেই কোভিডের কারণে লকডাউন শুরু হয়ে যায়, ফলে তখনই মামলাও করতে পারেননি তিনি।
কিছুদিন আগে নাবালিকা কন্যার কাস্টডি চেয়ে মহিলা মামলা দায়ের করেন ভারতের আদালতে। স্বামীর তরফে মূল অভিযোগ ছিল মহিলার সঙ্গে অন্য পুরুষের প্রেমের সম্পর্ক আছে – তাই তিনি সন্তান পালনের অযোগ্য। কোর্টে এই অভিযোগ ধোপে টেকেনি।
বিচারকের মনে হয়েছে, মাতৃত্ব ও পরিবারের সংজ্ঞা এখন বদলে গিয়েছে। বিশেষ করে এই মামলার আবেদনকারী নিজে যথেষ্ট প্রতিষ্ঠিত, তা ছাড়া নাবালক নাগরিকের দায়ভার বহন করার জন্য অস্ট্রেলিয়া সরকারও তাঁকে আর্থিক সাহায্য জোগাবে। বহু সিঙ্গল মা নিজের দায়িত্বে খুব ভালোভাবে সন্তানকে বড়ো করেছেন – এমন নজির আদালতের সামনে রয়েছে। এ ক্ষেত্রেই বা তার ব্যতিক্রম হবে কেন?
তাছাড়া একটা ব্যর্থ বিয়ের পর মহিলা কোনও সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছেন বলেই যে মা হিসেবে তাঁর দায়িত্ব পালনে অসুবিধে হবে, এমনটা ভেবে নেওয়ারও কোনও কারণ নেই। পরকীয়া প্রেমে যুক্ত হলেও সন্তানের সঙ্গে মায়ের সম্পর্ক পালটায় না। তাই যাতায়াতের বিধিনিষেধ উঠলেই সন্তানকে তাঁর কাছে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য থাকবে স্বামীর পরিবার, তার আগে তাঁর সঙ্গে বাচ্চার যোগাযোগ থাকবে ভিডিও কলের মাধ্যমে।
মাতৃত্ব নিঃসন্দেহে এক অপার্থিব অনুভূতি, কিন্তু মা হলেই যে নিজের সমস্ত শখ-আহ্লাদ বাতিল করে দিতে হবে বা সন্তানের জন্য ভুল সম্পর্কের বন্ধনে আটকে থাকতে হবে চিরটাকাল – এসব ধ্যানধারণা বদলাচ্ছে দ্রুত। আদালতের রায়ও তাতে সিলমোহর দিল।