ইয়াসের দাপটের পর যাঁরা দক্ষিণবঙ্গে ত্রাণের কাজে গিয়েছেন তাঁরা এক বাক্যে স্বীকার করে নেবেন যে সুন্দরবনের আশপাশের দ্বীপগুলির অবস্থা যত দিন যাচ্ছে, তত খারাপ হচ্ছে। আয়লা, ফণি, বুলবুল, আমফান, ইয়াস – প্রকৃতির একের পর এক রুদ্ররূপের সামনে মানুষ অসহায়।
কিন্তু স্রেফ প্রাণটুকু বাঁচলেই তো আর হবে না – মানুষকে করে খেতে হবে। জমিতে নোনা জল ঢুকে ফসল নষ্ট হয়, ঘর ভেসে যায় প্রতি বছর, গবাদি পশু, পুকুরের মাছ মরে বিষিয়ে ওঠে। এভাবে কি মানুষ থাকতে পারে? যুবসমাজ সুযোগ পেলেই ঘর ছেড়ে পাড়ি দেয় শহরে, অন্য রাজ্যে। তাদের পরিযায়ী শ্রমিক বলা যায়, কিন্তু এখন যে হারে দ্বীপের পর দ্বীপ তলিয়ে যাচ্ছে, তাতে পাকাপাকি ঘর ছাড়া বাদে অন্য উপায় আছে কি?
ইন্টারন্যাশনাল রেড ক্রস সোসাইটির হিসেব বলছে, রাজনৈতিক হানাহানি বা যুদ্ধের জন্য যত মানুষ ঘরছাড়া হন প্রতি বছর, তার চাইতে অনেক বেশি মানুষ ভিটে ছাড়েন পরিবেশের রুদ্ররূপের সঙ্গে যুঝতে না পেরে। ইউনাইটেড নেশনস হাই কমিশনার ফর রিফিউজিসের হিসেব বলছে, ২০৫০ সালের মধ্যে আনুমানিক ২০০ মিলিয়ন মানুষ প্রকৃতির কারণে বাসস্থান হারাবেন!
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক পত্রিকার বক্তব্য, উষ্ণায়ন নিয়ন্ত্রণে মানুষ এখনও পর্যন্ত কোনও সাফল্য সেই অর্থে পায়নি। কমানো যায়নি গাছ কাটা, কমেনি মাটি আর জলের দূষণ। সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা বেড়েছে বলেই বার বার ঘনিয়ে উঠছে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়। হিমবাহ গলতে আরম্ভ করলে সমুদ্রে জলের পরিমাণ বাড়বে, তার ফলে তলিয়ে যেতে পারে আরও বহু দ্বীপ। ১৯৯০ থেকে ২১০০-র মধ্যে সমুদ্রের জলের পরিমাণ ২ ফুট পর্যন্ত বাড়তে পারে – ফলে বঙ্গোপসাগরের বহু দ্বীপ সম্পূর্ণ তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকছেই।
ভেনিস, মালদ্বীপের মতো ট্যুরিস্টদের স্বপ্নের স্পটগুলিও ক্রমশ জলে ডুবছে – এ রিপোর্টের কথা এখন সবাই জানেন। নিরক্ষরেখার আশপাশে থাকা আফ্রিকার দেশগুলিতে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জলের কষ্ট আর খরা। ইথিওপিয়া, সোমালিয়া দুর্ভিক্ষ থেকে ঘুরে দাঁড়াতেই পারে না, সেখানকার বাচ্চারা ভয়াবহ অপুষ্টির শিকার।
সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হচ্ছে, প্রতিকূল পরিবেশের কারণে যাঁরা ঘরছাড়া হন, তাঁদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য কোনও আইন নেই। কোনও রাজনৈতিক বা ধর্মীয় নিরাপত্তার বলয় এঁদের ঘিরে থাকে না। ফিরে যাওয়ার ঘর নেই, আশ্রয় মেলার আশা নেই। সারা জীবন পশুপালন বা চাষআবাদ করার পর শহরে গিয়ে ছোটোখাটো কাজ খুঁজে নিতেও এঁদের সমস্যা হয়। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখানো বা স্বাস্থ্যসুরক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থাও থাকে না — অনেক সময় তো রিফিউজি তকমাটুকু জুটতে বছর ঘুরে যায়, ত্রাণ তো দূর অস্ত!
(ছবির ব্যবহার প্রতিনিধিত্বমূলক)