দিনটা ছিল রবিবার, ৭ ফেব্রুয়ারি। উত্তরাখণ্ডের লাসু গ্রামে সকাল হচ্ছে ধীরে ধীরে। পাশ দিয়েই বয়ে চলা অলকানন্দা নদীর আশপাশে তখনও প্রাতর্ভ্রমণকারীরা রয়েছেন। আচমকাই একজনের চোখে পড়ে, নদীর একেবারে তীর ঘেঁষে হুড়মুড়িয়ে ভেসে আসছে রুপোলি মাছের সারি।
সাধারণত মাছ মানুষের হাতে ধরা পড়তে চায় না বলেই যাতায়াত করে মাঝনদী বরাবর। কিন্তু খানিকক্ষণের মধ্যেই দেখা যায় নদীর জল রুপোরং ধরেছে, ক্রমশ বাড়ছে উজানে চলার মাছের সংখ্যা, লোকজন বালতি, ড্রাম, ঝুড়ি ডুবিয়ে শয়ে শয়ে মাছ তুলতে আরম্ভ করে। নন্দপ্রয়াগ, কর্ণপ্রয়াগ সর্বত্র এ দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি দেখা যায়। তার ঘণ্টাদেড়েক পরেই অনেকটা উপরে, চামোলি জেলায় অলকানন্দার শাখানদী ধৌলিগঙ্গায় হড়কা বান আসে হিমবাহ ভেঙে পড়ায়, ভেসে যায় জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র, সলিলসমাধি হয় শয়ে শয়ে শ্রমিকের।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে আরম্ভ করে, মাছেরা কি আগে থেকে আঁচ করতে পেরেছিল? বিপর্যয়ের কিছু আগে থেকে নাকি পাহাড়ি নদীর কাকচক্ষু জল ঘোলা হতে আরম্ভ করেছিল, ভেসে আসছিল কাদামাটির তিরতিরে স্রোত, স্থানীয়দের চোখে পড়লেও ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কুডাক ডাকেনি। মনুষ্যেতর প্রাণিরা কিন্তু ঠিক বুঝতে পেরে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে নিচের দিকে নামতে আরম্ভ করে।
যে কোনও বড়ো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আগেই প্রাণিদের আচরণে কিছু পরিবর্তন দেখা গিয়েছে। সুনামির আগে নাকি তাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কার সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলে বহু পোষ্য কুকুর ভয়ানক আতঙ্কে খাটের তলায় ঢুকে থেকেছে, প্রাতঃকৃত্য করতেও বেরোতে চায়নি। ২০১১ সালে পেরুতে এক ভূমিকম্পের আগে পাখি আর স্তন্যপায়ী প্রাণিদের আচরণে উল্লেখযোগ্য কিছু পরিবর্তন দেখা গিয়েছিল।
২০০৯ সালে ইতালির এক বিজ্ঞানী লক্ষ করেন যে, প্রজনন ঋতুতে তাঁর বাড়ির আশপাশ থেকে আচমকাই কোনও ব্যাঙের ডাক ভেসে আসছে না, ব্যাঙের দেখাও মেলেনি কোথাও। ঠিক দু’দিনের মাথায় ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়, তার বেশ কিছুদিন পরেও মাটি বার বার কেঁপে উঠত আফটার শকে। যেদিন থেকে ব্যাঙের হাঁকডাক শোনা গেল, তার পর থেকে মাটি আর এক বারও কাঁপেনি। পৃথিবীর ভিতরের তোলপাড় থামার পরেই ফিরেছে ব্যাঙের দল – এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর মতো কোনও প্রমাণ পাননি সেই বিজ্ঞানী।
একটা কথা ঠিক, প্রকৃতির সঙ্গে প্রাণিদের যোগ এখনও অনেক গভীর। আবহাওয়ায় সামান্য পরিবর্তন এলেও তারা বুঝতে পারে। ধরতে পারে খুব সূক্ষ্ম শব্দ, বা বিচিত্র গন্ধের রেশ, দেখতে পায় অন্ধকারে। আদিম প্রকৃতির সঙ্গে সর্বক্ষণ বেঁচে থাকার লড়াই চলে বলে তাদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় খুব সজাগ। একদল বিজ্ঞানী মনে করেন যে, মানুষেরও এক কালে তেমনটাই ছিল, ব্যবহার না হওয়ায় ধার কমে গিয়েছে ক্রমশ।
আর সেই কারণেই প্রাণির আচরণে পরিবর্তন দেখলেই নিশ্চিতভাবে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারে না মানুষ, সব সময়ে সঠিক কারণ খুঁজেও বের করা যায় না তখনই – সময় লেগে যায়। তবে আশার কথা একটাই – গবেষণা জারি আছে।