নোভেল করোনা ভাইরাস নিয়ে নিত্যদিন গবেষণা চলছে গোটা পৃথিবী জুড়ে – তবে এখনও পর্যন্ত যা অবস্থা, তাতে এই ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণ করার উপায় বের করা যায়নি। অনেক বিজ্ঞানীর ধারণা, কিছুদিনের মধ্যেই হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হয়ে যাবে মানুষের শরীরে। তার পাশাপাশিই আসবে প্রতিষেধক টিকা। দুয়ের মিলিত আক্রমণে কাবু হবে কোভিড, আবার আমরা ফিরব স্বাভাবিক জীবনে।
কিন্তু বিষয়টি কি সত্যিই এতটা সরল? আসুন, নজর রাখা যাক সাম্প্রতিক কয়েকটি তথ্য প্রমাণের দিকে। যখন একটি জনসংখ্যার বেশিরভাগই কোনও জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হয়ে যান, তখন তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার ম্যাজিক ফর্মুলা আবিষ্কার করে ফেলে সেই জনগোষ্ঠীর শরীর – একেই বলে হার্ড ইমিউনিটি।
আর ভ্যাকসিন বিষয়ে তো কম-বেশি সবারই অল্পবিস্তর ধারণা আছে। আমাদের দেশে একটা সময়ে স্মল পক্স বা চিকেন পক্সকেই মারণ রোগ বলা হত, কিন্তু ইদানীং সব শিশুকেই ছেলেবেলায় এই দুই ধরনের পক্সের টিকা দেওয়া হয় কমন ইমিউনাইজেশন প্রোগ্রামের আওতায় – রোগও দাঁত-নখ হারিয়েছে।
কিন্তু করোনার ক্ষেত্রে হার্ড ইমিউনিটি আর ভ্যাকসিন কতটা কার্যকর হতে পারে? তাও আবার এত অল্প সময়ের মধ্যে? এই বিষয়টি বোঝবার জন্য নিজেকে দু’-দু’বার এই মারণ ভাইরাসের সাহায্যে সংক্রমিত করিয়েছেন রাশিয়ান বিজ্ঞানী ডা. আলেকজান্ডার চেপারনভ। এই ৬৯ বছর বয়সি মানুষটি ফ্রান্সে ছুটি কাটাতে গিয়েছিলেন ফেব্রুয়ারি মাসে – সে দেশে তখন ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে মারণ ভাইরাস। ডা. চেপারনভও সংক্রমিত হন, তবে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়নি। সাইবেরিয়ার বাড়িতে ফিরে ক্রমশ সুস্থ হয়ে ওঠেন নিজে থেকেই।
তার পর তাঁর মনে হয়, নিজের ইমিউনিটি বা প্রতিরোধক্ষমতা কতটা, তার পরীক্ষা নেওয়া উচিত। যে গবেষণাগারে তিনি কর্মরত, সেই ইনস্টিটিউট অফ ক্লিনিকাল অ্যান্ড এক্সপেরিমেন্টাল মেডিসিন, নোভোসিভিরস্ক-এ তাঁর সহকর্মীরা মাপতে থাকেন তাঁর শরীরের অ্যান্টিবডি ও প্রতিরোধক্ষমতার পরিমাণ।
দেখা যায়, যে কোষগুলি করোনা ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করেছিল, রোগ সেরে যাওয়ার পর থেকে সেগুলি ক্রমশ কমতে আরম্ভ করে। মাস তিনেকের মধ্যে প্রতিরোধী অ্যান্টিবডিও বিলুপ্ত হয়। এর পর থেকে সচেতনভাবেই তিনি মাস্ক ছাড়া কোভিড পেশেন্ট দেখতে আরম্ভ করেন – উদ্দেশ্য ছিল ফের সংক্রমিত হয়ে দেখা শরীর কীভাবে সাড়া দেয়।
প্রথম ইনফেকশনের ছ’মাস পর দ্বিতীয়বার কোভিড হয় ডা. চেপারনভের। শুরুটা হয় গলা খুসখুস দিয়ে, তার পর জ্বর আসে, চলে যায় স্বাদ ও গন্ধের বোধ। জ্বর মাত্রাছাড়া বাড়েনি, পাঁচ দিন পর কমে যায়। তখনও ফুসফুসে কোনও সংক্রমণ ছিল না, কিন্তু দিন দুই-তিন পর দেখা যায় তিনি ডাবল নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত। হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা শুরু হয়। তবে সপ্তাহ দুয়েক পর ভাইরাসের হাত থেকে মুক্তি পান তিনি।
ডা. চেপারনভের এই পরীক্ষার পর ফের ভাঁজ পড়েছে বিজ্ঞানীদের কপালে। তাঁর মূল বক্তব্য দু’টি – এক, একবার আক্রান্ত হওয়া ব্যক্তির দ্বিতীরবার সংক্রমণ হতেই পারে এবং একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর শরীরে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি মোটেই কার্যকর থাকে না। ফলে হার্ড ইমিউনিটিও অনির্দিষ্টকাল ধরে সুরক্ষা জোগাবে, এমনটা ভেবে নেওয়া ভুল। দুই, ভ্যাকসিনের একটা ডোজও দীর্ঘদিন কার্যকর থাকবে না, এমন প্রতিষেধক চাই যা ভাইরাসের বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাবে।
যেহেতু পৃথিবীর নানা দেশে গবেষণা চলছে, তাই আশা করা যায় কেউ না কেউ নিশ্চিতভাবেই এই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করে ফেলবেন। ভ্যাকসিন বাজারে আসার কথা সামনের বছরে। তার মানেই তা সব মানুষের হাতের নাগালে চলে আসবে, সেটা ভেবে নেওয়া ভুল। তবে সাধারণ মানুষের স্বার্থের দিকটা দেখলে মানতেই হবে যে, যত তাড়াতাড়ি সমাধানে পৌঁছনো যায়, ততই মঙ্গল!