সারা দেশ জুড়ে সবে খুলতে আরম্ভ করছিল স্কুল-কলেজ, ক্রমশ স্বাভাবিক হচ্ছিল জীবনযাত্রা। তার মাঝেই ফের বাড়তে শুরু করেছে করোনা সংক্রমণ। নভেম্বর থেকেই সংক্রমিতের সংখ্যা কমছিল, একটা সময়ে গ্রাফ নিম্নমুখি হতে আরম্ভ করে। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে কলকাতা-বিধাননগরসহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে সংক্রমিতের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা।
কিন্তু গত পাঁচদিনের রেখচিত্র দেখে ভুরুতে ভাঁজ পড়ছে অনেক বিশেষজ্ঞেরই – কারণ এ দেশে ফের সংক্রমণের হার ঊর্ধ্বমুখি হতে আরম্ভ করেছে। মহারাষ্ট্র, কর্নাটক আর কেরল এ দফাতেও এগিয়ে আছে অন্যান্য রাজ্যের চেয়ে। বিদর্ভের তিনটি জেলা – আকোলা, যবতমল আর অমরাবতীর বিস্তীর্ণ এলাকাকে কনটেনমেন্ট জোন ঘোষণা করা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমতি ছাড়া পুরো লকডাউন ঘোষণার এক্তিয়ার নেই কোনও রাজ্য সরকারের, তবে নাগরিকদের সমস্ত স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্বের নিয়ম মেনে চলার অনুরোধ করা হচ্ছে বার বার। বিদর্ভের বাকি ১১টি জেলাতেও বাড়ছে সংক্রমণ, সেখানে লাগু করা হয়েছে কঠিন নিয়মকানুন।
এরই মধ্যে আকোলা ও অমরাবতীতে পাওয়া গিয়েছে ভাইরাসের নতুন এক স্ট্রেন, তার প্রভাবে রোগীর আক্রান্ত হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই ভয়াবহ নিউমোনিয়া হচ্ছে, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ফুসফুস। এই স্ট্রেনটি ছড়িয়েও পড়ছে খুব দ্রুত। এখনই সংক্রমণের হার নিয়ন্ত্রণে না এলে বহু মানুষের প্রাণহানি হতে পারে, এমন একটা সন্দেহ দানা বাঁধছে চিকিৎসক মহলে।
কেরলে সংক্রমণ বাড়ার পিছনে অবশ্য একদল বিশেষজ্ঞ প্রথম দফার সাফল্যকেই কাঠগড়ায় তুলেছেন। কেরল যেভাবে ‘ব্রেক দ্য চেন’ মন্ত্র কাজে লাগিয়ে সংক্রমণ ঠেকিয়ে সারা বিশ্বের রোল মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছিল, সেটাই নাকি এই দ্বিতীয় দফায় হু-হু করে রোগীর সংখ্যাবৃদ্ধির মূল কারণ! সমীক্ষা বলছে, সারা ভারতে প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজনের শরীরে কোভিডের অ্যান্টিবডি মিলেছে। কেরলের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা প্রতি ১০ জনের মধ্যে এক।
জঙ্গলে যখন আগুন লাগে, তা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। একটা সময় শুকনো কাঠ আর পাতার অভাবে আগুনে নিজেই থেমে যায়। যে কোনও মহামারী বা অতিমারীর ক্ষেত্রেও নিয়মটা তাই। কিছু মানুষ রোগে আক্রান্ত হন, তাঁদের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। যাঁদের ইমিউনিটি বা প্রতিরোধক্ষমতা সুরক্ষা জোগায়, তাঁদের অসুখটা কাবু করতে পারে না।
আর একদল থাকেন, যাঁরা অসুস্থদের সংস্পর্শে আসেন এবং রোগ সংক্রমণের ধারা অব্যাহত রাখেন। বাইরে থেকে দেখে বোঝা যায় না কার শরীর ভাইরাসের সঙ্গে কীভাবে লড়বে। ভ্যাকসিন নিলে প্রাকৃতিক ইমিউনিটি আরও বাড়ে।
সব মিলিয়ে সমাজ এমন একটা জায়গায় পৌঁছয় যখন ভাইরাস আর নতুন কাউকে সংক্রমিত করতে পারে না – এই স্তরটাকেই হার্ড ইমিউনিটি বলা হয়। যেহেতু কেরলে বহু মানুষ প্রথম দফায় সংক্রমণ এড়িয়ে গিয়েছেন, তাই এখন রোগ ছড়াচ্ছে দ্রুত। সেই সঙ্গে খেয়াল রাখতে হবে যে এ রাজ্যে ওবেসিটি রেটও মারাত্বক হাই, সেটাও সংক্রমণ ছড়ানোর অন্যতম কারণ হতে পারে।
কেন কমে গিয়েছিল কোভিড সংক্রমণ, তার কোনও জবাব নেই বিশেষজ্ঞদের কাছে। তেমনই তা ফের কেন বাড়তে আরম্ভ করেছে, সে সম্পর্কেও পরিষ্কার ধারণা নেই কারওই। তবে সাধারণ মানুষ হিসেবে আমরা যে রোগের গুরুত্বটাকে উড়িয়েই দিয়েছি প্রায়, তা নিয়ে কিন্তু কোনও সন্দেহই থাকতে পারে না!
সোশাল ডিসট্যান্সিং শিকেয় তুলে স্রোতের মতো মানুষ বেরোচ্ছেন রাস্তায়, মাস্ক পরার বালাই নেই! হাত ধোয়া, স্যানিটাইজার ব্যবহারেও বিরক্তি। তার পর ভিড় হচ্ছে ট্রেনে, বাসে। সিনেমা, থিয়েটার দেখতে হলে যাচ্ছেন বহু মানুষ। এই পরিস্থিতিতে যদি ফের লাগামছাড়া সংক্রমণ বাড়ে, তা হলে দায়টা কার? মাস্কহীন অবস্থায় আপনাকে দেখলে পুলিশ হয়তো আটক করবে, ফাইনও করা হতে পারে। কিন্তু নিজেকে নিরাপদ রাখার দায়টা তো আপনার!
এ বছরটাও মাস্ক, সোশাল ডিসট্যান্সিং, হাত ধোয়া, স্যানিটাইজার ব্যবহারের অভ্যেসটা চালিয়ে যেতে বলছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এখনও নিশ্চিন্ত হওয়ার সময় আসেনি, এটা মাথায় রাখবেন!