আপনার যদি এ বিষয়ে মনে কোনও সন্দেহ থাকে, তা হলে একবার পাঠ্যক্রম আর পরীক্ষার সিলেবাসের দিকে তাকিয়ে দেখুন। সিবিএসই, আইসিএসই, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বোর্ড দশম ও দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষার্থীদের সিলেবাস অনেকটাই কমিয়েছে।
এবার মধ্যশিক্ষা পর্ষদ প্রথম থেকে নবম শ্রেণির পাঠ্যক্রমও ৩০-৩৫% কমিয়ে দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে – তা ঘোষণা হওয়াটা স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। কেন এই সিদ্ধান্ত? বলার অপেক্ষা রাখে না যে সরকারি দফতরও বুঝতে পারছে যে অনলাইন ক্লাসে পুরো সিলেবাস শেষ করা ও পরীক্ষা নিয়ে পড়ুয়াদের শেখার পরিমাপ করাটা কার্যত অসম্ভব।
. UNICEF-এর হিসেব বলছে, এই পৃথিবীতে ৩-১৭ বছর বয়সের যত ছেলেমেয়ে ইশকুলে পড়ে, তাদের দুই তৃতীয়াংশের বাড়িতেই ইন্টারনেট সংযোগ নেই। সংস্থার এগজিকিউটিভ ডিরেক্টর হেনরিয়েটা ফোর বলছেন, “এটাকে ডিজিটাল গ্যাপ নয়, ডিজিটাল ক্যানিয়ন বলা উচিত। এ কথা মেনে নিতেই হবে যে, ইন্টারনেটের অভাবে ভবিষ্যতের একটা গোটা প্রজন্মের শিক্ষায় বিরাট গ্যাপ তৈরি হয়ে গেল।” ভারতের ক্ষেত্রে অন্তত ৫০% ছাত্রছাত্রীর ইন্টারনেট নেই।
. ধরুন ইন্টারনেটের ব্যবস্থা হল। এবার ক্লাস করার জন্য ছাত্রছাত্রীর একটা নিজস্ব ল্যাপটপ, ট্যাবলেট বা নিদেনপক্ষে স্মার্টফোন দরকার। NCERT-র সাম্প্রতিক সমীক্ষা বলছে, এ দেশের ২৭% ছাত্রছাত্রীর হাতে ক্লাস করার উপযোগী ডিভাইস নেই। যাদের আছে, তাদের মধ্যে একটা বিরাট অংশ বিদ্যুতের অভাবে নাজেহাল – গ্রামে-গঞ্জে বিদ্যুৎব্যবস্থা এখনও বেহাল, সেই সঙ্গে রয়েছে ইন্টারনেট কানেক্টিভিটির সমস্যা।
. কী বলছেন? আপনার বাচ্চার এ সব কোনও অসুবিধেই নেই? তার হাতে ডিভাইস দিয়ে আপনারা দু’জন কাজে বেরিয়ে যাচ্ছেন। বাচ্চা যে ক্লাসই করছে, তার কিন্তু নিশ্চয়তা নেই। তারা ক্লাসের সময়ে গেম খেলছে, নির্বিবাদে পর্ন দেখছে, ক্লাস ডিসটার্ব করছে, নিজেদের মধ্যে চ্যাট করছে। সব সময়ে শিক্ষক-শিক্ষিকারা তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। তাঁদেরও একেবারে নতুন একটা সিস্টেমের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে গিয়ে নাজেহাল হতে হচ্ছে প্রতিদিন।
. বহু দরিদ্র ছাত্রছাত্রীর কাছে কোভিড অভিশাপ হয়ে নেমে এসেছে। পারিবারিক উপার্জন কমেছে, স্কুলে মিড ডে মিল পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই। বরাবরের মতো স্কুলছুট হয়েছে বহু ছাত্র, নেমে পড়েছে রোজগারে। এদের আর কখনও স্কুল ফিরিয়ে আনা যাবে কিনা তা নিয়েও সন্দেহ আছে।
. যাঁরা বলেন, হোম স্কুলিংয়ের মাধ্যমেও শিক্ষাদান সম্ভব, তাঁরা ভুলে যাচ্ছেন যে সাধারণ স্কুল বাড়িতে আনা আর হোম স্কুলিং একেবারেই ভিন্ন পদ্ধতি। দুটো কারিকুলাম আলাদা, পরীক্ষা পদ্ধতিও ভিন্ন। অনলাইন ক্লাস বা কোচিংয়ে আমাদের দেশের সাধারণ সিলেবাসের পুরোটা করানো সম্ভব নয় – বিস্তর ফাঁকফোকর থাকবেই।
. এবার প্রশ্ন উঠবে নিরাপত্তার। কোভিডের তৃতীয় ঢেউ যেখানে ঘাড়ের উপর, সেখানে পুজোর পর স্কুল খুললেই কি বাচ্চাকে পাঠানো উচিত? এ সিদ্ধান্ত শিশুর বাবা-মা নেবেন। তার কারণ আপনি বাচ্চাকে কীভাবে স্কুলের দরজা পর্যন্ত নিয়ে যাচ্ছেন, তার উপরেও অনেক কিছু নির্ভর করবে। সব অভিভাবকের পক্ষে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে বাচ্চাকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া আসা মুশকিল। কিন্তু এটাও ঠিক যে বাচ্চার মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে স্কুল ও বন্ধুবান্ধবের বিরাট ভূমিকা থাকে। তার থেকে দীর্ঘ সময় দূরে থাকলে নানা অসুবিধে হবেই। সেটা হচ্ছেও।
. বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোভিড আগামীদিনেও থাকবে। তার সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকতেও হবে। একেবারে ছোটো থেকেই বাচ্চাকে নিরাপত্তাবিধি মানতে শেখান। সে মাস্ক পরুক, হাত ধুয়ে নিক বার বার। আপাতত বন্ধ থাক কাছাকাছি বসা, টিফিন বা পেনসিল বাক্স শেয়ার করা। কিন্তু স্কুলে না গেলে তার না-জানার পরিধি ক্রমশ বাড়বে, সেই চাপ বহন করা আরও কঠিন হবে কিন্তু!