ভারত অস্ট্রেলিয়া সফরে গিয়ে জিতেছে বর্ডার-গাভাস্কর ট্রফি – এই নিয়ে টানা দু’বার। ব্রিসবেনের শেষ টেস্টে দুই ইনিংসেই অস্ট্রেলিয়ার ১০জন ব্যাটসম্যানকে আউট করেছেন ভারতীয় বোলাররা – যে কোনও সফররত দলের কাছেই এটা বিরাট ব্যাপার। তার মধ্যে আবার ভারতের প্রথম সারির অধিকাংশ খেলোয়াড় শেষ টেস্টে চোট-আঘাত পেয়ে মূল একাদশের বাইরে ছিলেন – ম্যাচ জিতিয়েছেন একেবারেই তরুণ তুর্কিরা। মোদ্দা কথা – নানা কারণে ভারতের এবারের অস্ট্রেলিয়া সফর ঐতিহাসিক হয়ে থাকবে।
কিন্তু তার চেয়েও বড়ো কথা, এই সিরিজ এমন কয়েকটি শিক্ষা দিয়ে গেল, যা আমাদের রোজের জীবনেও কাজে লাগবে। আপনি এখনও সেই মিলটা খুঁজে পাননি, তাই না? আসুন, আমরা সাহায্য করছি!
১. কখনও লক্ষ্য থেকে চোখ সরাবেন না
করোনা পরিস্থিতিতে দীর্ঘদিন কঠোর লকডাউনে কার্যত ঘরবন্দি হয়ে কাটিয়েছেন বেশিরভাগ তারকা প্লেয়ার। আন্তর্জাতিক মানের যে কোনও খেলোয়াড়ের কাছেই এই ধরনের পরিস্থিতি একেবারেই কাম্য নয়, তার কারণ দীর্ঘ অবসরে ফিটনেস আর রিফ্লেক্সের বারোটা বেজে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
মনে রাখতে হবে বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মার মতো কিছু খেলোয়াড়ের বাড়িতে জিমের সুবিধে থাকতে পারে, বেশিরভাগ তরুণ খেলোয়াড়েরই তা ছিল না। হয়তো সেই কারণেই এবার প্লেয়ারদের চোট-আঘাতে ভুগতে হচ্ছে বেশি। চতুর্থ টেস্টে পুরো টিম নামানো মুশকিল হয়ে যাচ্ছিল, অনেকে চোট নিয়েই মাঠে নেমেছেন। কিন্তু অদম্য মনের জোর হারাননি খেলোয়াড়রা।
আমরা কী শিখলাম: বাধা-বিপত্তি আসবেই, তাতে জীবন থেমে যাবে না। যে কাজটা আপনি ভালো পারেন, সেই স্কিলটাকে ভোঁতা করে ফেলবেন না। রোজ শান দিন। প্রস্তুত থাকুন। হয়তো আজ চাকরি নেই বা রোজগার কমে গিয়েছে, তাতে ভেঙে পড়লে চলবে না। জীবন নিয়ে স্বপ্ন দেখুন, সেই লক্ষ্যে এগোতে থাকুন। একটা সময় কোনও বাধাই আপনাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।
২. স্বপ্ন দেখুন, স্বপ্নই আপনাকে তাজা রাখবে
ভুললে চলবে না, প্রথম টেস্টে অস্ট্রেলিয়া দুর্মুশ করে দিয়েছিল ভারতকে। ৩৬-এ অল আউট হওয়ার পর দেশি-বিদেশি মিডিয়া রীতিমতো তাচ্ছিল্য করেছে টিম ইন্ডিয়ার মান নিয়ে। সেই সমালোচনার ঝড়ে মনোবল না হারিয়ে বাকি তিন টেস্টের একটিতে ড্র আর দু’টি জেতা কিন্তু চাট্টিখানি কথা নয়! বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়ার ঘরের মাঠে তুমুল স্লেজিং এবং বর্ণবিদ্বেষী মন্তব্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়েও লড়াই চালিয়ে যাওয়াটা মানসিক যুদ্ধও বটে!
আমরা কী শিখলাম: একটা হার বা অন্য বন্ধুবান্ধবের চেয়ে পিছিয়ে পড়া কিচ্ছু প্রমাণ করে না! কারও সাফল্য বা ব্যর্থতার মাপকাঠিতে নিজেকে মাপতে যাবেন না। প্রত্যেকটা দিন নতুন করে শুরু করুন, কাল কী হয়েছে ভুলে যান। খুব কঠিন সময়ের মুখোমুখি হলেও স্বপ্ন দেখা বন্ধ করবেন না।
৩. সাফল্য রাতারাতি আসে না, তার পিছনে অনেক সময় দিতে হয়
সিরিজ চলাকালীন যখন বিরাট কোহলি সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর পাশে থাকার জন্য দেশে ফিরে এলেন, তখন তাঁর ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল। তার কিছুদিন পর যখন ভারত দ্বিতীয় টেস্ট জিতল, তখন বলা হল কোহলি বিদেয় হওয়ায় টিম মনোবল ফিরে পেয়েছে। কিন্তু ঐতিহাসিক সিরিজ জয়ের পর হেড কোচ রবি শাস্ত্রী প্রথমেই বিরাটকে অভিনন্দন জানালেন — কারণ এই জয়ী টিমটাও তাঁরই হাতে তিল তিল করে গড়া। হার-জিতের খেলাটা রাতারাতি বদলে যায়, ধরে রাখতে হয় মনোবল।
আমরা কী শিখলাম: বাইরের লোক কী বলল তাতে কান দেবেন না। কুকথা, সমালোচনা হবেই – সেটা জীবনের একটা অঙ্গ। হনুমা ভিহারি যখন বুক চিতিয়ে মাটি কামড়ে ক্রিজে পড়ে থেকে অস্ট্রেলিয়ার আগুনে বোলিং সামলে দলকে ধীরে ধীরে ড্রয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তাঁকে যাচ্ছেতাইভাবে গালিগালাজ করেছে একদল ক্রিকেট বোদ্ধা। কিন্তু এই সিরিজটা নিয়ে যত দিন কথা হবে, ততদিন হনুমার নামটাও উঠে আসবেই। এবার আপনিই ঠিক করুন কী করবেন।
৪. সুযোগ আগে থেকে বলে আসে না
ওয়াশিংটন সুন্দর, শার্দূল ঠাকুর, মহম্মদ সিরাজ, মাত্র ২১ বছরের শুভমান গিল, হনুমা ভিহারি — এক ঝাঁক ক্রিকেটার যেভাবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের আঙিনায় ফুটে উঠলেন এবং পারফর্ম করলেন, তাতে বহু পোড়খাওয়া সিনিয়রের কপালে ভাঁজ পড়ার কথা। ভুললে চলবে না, অস্ট্রেলিয়ার টিমটা কিন্তু হেলাফেলা করার মতো না! একে ঘরের মাঠ, তার উপর রয়েছেন প্যাট কামিন্স, জশ হেজলউড, মিচেল স্টার্ক, নেথান লায়নের মতো আগুনে বোলার; স্টিভ স্মিথ, ডেভিড ওয়ার্নার, মার্নাস লাবুশানের মতো বাঘা ব্যাটসম্যান। চোট আঘাতে পর্যুদস্ত একটা টিমের নতুন মুখেরা কোন ম্যাজিকে সফল হল তার উত্তর ক্রিকেট দুনিয়া বহুদিন খুঁজবে!
আমরা কী শিখলাম: সুযোগের অপেক্ষায় থাকুন, সেটা পেলেই কাজে লাগানোর চেষ্টা করুন। তাতে জীবনে কোনও আক্ষেপ থাকবে না। ভাগ্য তারই সহায় হয় যে চেষ্টা করে।
৫. নিজেকে কখনও ছোট ভাববেন না
টি নটরাজনের বাবা-মা সালেমে একটি মুরগির মাংসের স্টলমালিক। মহম্মদ সিরাজের সদ্য প্রয়াত বাবা হায়দরাবাদের অটো রিকশাচালক, নভদীপ সাইনির শিকড় কার্নালে, শার্দূল ঠাকুর পালগড়ের মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। অজিঙ্কা রাহানে একটা সময় দোম্বিভলি থেকে ভোরের ট্রেনে ধাক্কা খেতে খেতে মুম্বই শহরে আসতেন প্র্যাকটিস করতে। এঁরা টিম ইন্ডিয়ায় জায়গা করে নিয়েছেন ও সাফল্য পেয়েছেন একেবারে নিজের প্রতিভার জেরে।
আমরা কী শিখলাম: ছোটো শহরে থাকেন বলে আত্মবিশ্বাস কম? মন ছোটো করবেন না, নিজের যোগ্যতার উপর আস্থা রাখুন। সুযোগ পেলে কাজে লাগান, স্বপ্ন দেখুন। সেটাই আপনাকে আর পাঁচজনের চেয়ে আলাদা করে দেবে।