রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সাম্প্রতিক রিপোর্ট বলছে, মধ্যবিত্তের পকেটে যে বিলক্ষণ টান পড়েছে, তা মানুষের সঞ্চয়ের অবস্থা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ব্যাঙ্কে জমা টাকার রাশি কমছে, নতুন বিনিয়োগের সংখ্যা কম, ম্যাচিওরড হওয়া মাত্রই টাকা তুলে নিচ্ছেন মানুষ – এই ট্রেন্ড কার্যত অর্থনীতিকে আরও বিপদে ফেলবে।
রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এতগুলি হিসেব দাখিল করেছে স্রেফ গত বছরের এপ্রিল-জুন থেকে আরম্ভ করে অক্টোবর-ডিসেম্বর কোয়ার্টারের নিরিখে। দেখা গিয়েছে, এপ্রিল-জুনে গৃহস্থের সঞ্চয় ছিল গড় জাতীয় আয়ের ২১%। জুলাই-সেপ্টেম্বরে তা নেমে আসে ১০.২% -এ। তৃতীয় কোয়ার্টারে তা ৮.২% এসে দাঁড়ায়। এ বছরের হিসেব এখনও করাই হয়নি, হলে এই চিত্রটা আরও খারাপ দেখাবে নিঃসন্দেহে।
গত বছরের মার্চ মাসে যখন লকডাউন ঘোষিত হয়, তখনও মানুষ বুঝতে পারেনি অবস্থা কোনদিকে যাচ্ছে। জুন-জুলাই থেকে বাড়তে আরম্ভ করে কর্মহীনতা। তার পর অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর একটা চেষ্টা শুরু করেছিল সবে, তখনই ফের বাড়তে থাকে সংক্রমণ। হাসপাতালে নিকটজনকে ভর্তি করলে যে জলের মতো টাকা খরচ হবে, সেটাও পরিষ্কার হয়।
তার পর ফের একটা লকডাউন হয়েছে, যে সব পরিবারে একাধিক সদস্যকে হাসপাতালে থাকতে হয়েছে তারা চরম আর্থিক কষ্টের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। গত বছরের দ্বিতীয় কোয়ার্টারে জিডিপির ৭.৭% ছিল সাধারণ মানুষের ব্যাঙ্কে জমিয়ে রাখা টাকা। তৃতীয় বা অক্টোবর-ডিসেম্বরে তা নেমে ৩% হয়ে দাঁড়ায়। এ বছরের হিসেব নিশ্চিতভাবেই আরও খারাপ। সঞ্চয় কমার পাশাপাশি বাড়ছে মানুষের ঋণ নেওয়ার প্রবণতা।
অতিমারির ধাক্কা তো আছেই, তার পাশাপাশি মানুষের জীবনদর্শনে যে একটা বড়োসড়ো পরিবর্তন এসেছে গত কয়েক বছরে, সেটাও একবার ভেবে দেখতে হবে। আজকের প্রজন্ম জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত থেকে সবটুকু রস শুষে নিতে চায় – তাদের কাছে ভবিষ্যতের জন্য টাকা জমিয়ে রাখাটা তেমন জরুরি নয়।
দরকারে ঋণ নিয়ে হলেও দামী গ্যাজেট কিনতে হবে, মিটিয়ে ফেলতে হবে বিদেশভ্রমণ বা বিলাসবহুল গাড়ি চড়ার শখ – এমনটাই এখন ট্রেন্ডিং। তাই কিছুদিন হল ঋণ নেওয়া বেড়েছে, কমেছে ব্যাঙ্কে জমা রাশির পরিমাণ। তবে বেসরকারি নন-ব্যাঙ্কিং সেক্টর থেকে ঋণ নেওয়ার হার খানিকটা হলেও কমেছে।
এবার সবচেয়ে জরুরি প্রশ্ন – মানুষ সঞ্চয় না করলে রাষ্ট্রের কী সমস্যা হতে পারে?
. ভারতের ইনভেস্টমেন্ট ফান্ডিংয়ের একটা বড়ো অংশ আসে ব্যাঙ্কে গৃহস্থের জমিয়ে রাখা টাকা থেকেই। সঞ্চয় না বাড়লে শিল্পক্ষেত্রে সরকার ঋণ দিতে পারবে না। এখন যা পরিস্থিতি, তাতে শিল্পপতিরা সংস্থা টিকিয়ে রাখার জন্যেও সরকারি ছাড় ও ধারের অপেক্ষায় বসে আছেন। সরকার ব্যাঙ্কে জমিয়ে রাখা নানা ডিপোজিট ও সঞ্চয় প্রকল্পের টাকাই বাজারে ছাড়ে। সেই ভান্ডারে ঘাটতি দেখা দিল শিল্প ক্ষেত্রে ধুঁকতে আরম্ভ করবে, ফলে কর্মহীনতা আরও বাড়বে।
. মানুষ যখন দামি জিনিসপত্র কেনে, তখন সঞ্চয় ভাঙিয়ে খানিকটা ডাউন পেমেন্ট করে। বাকি টাকাটা ঋণ নেয় বেসরকারি ক্ষেত্র থেকে, পরে সেটা ইএমআইয়ের মাধ্যমে মিটিয়ে দেয়। আপাতত এই ক্ষেত্রটা পুরোই শুকিয়ে গিয়েছে – মধ্যবিত্ত সাধ্যের বাইরে গিয়ে দামি জিনিস মোটেই কিনছে না। যারা কিনছে, তাদের ঋণ লাগছে না। ফলে একসঙ্গে অনেকগুলি সেক্টরের উপর চাপ বাড়ছে।
. সারা দেশে প্রতি বছর মোট যে টাকা সঞ্চয় হয়, তার প্রায় অর্ধেক আসে গৃহস্থের পকেট থেকে। আপাতত সেখানেই টান ধরেছে, সংসার চালাতে নাভিশ্বাস উঠছে। থমকে গিয়েছে রিয়েল এস্টেটের বিক্রিবাটা, বহু চাকরিজীবী ফিরে গিয়েছে পৈতৃক বাড়িতে। তাই গৃহস্থের হাতে টাকার জোগান যতদিন না বাড়বে, ততদিন জিডিপি উন্নত হওয়ার আশা নেই।