খাওয়ার জন্য আপনি কত টাকা খরচ করতে রাজি আছেন? যদি বলি, এমন একটি খাদ্যবস্তু আছে, যার দাম সোনার চেয়েও বেশি, তা হলে কি তা কেনার কথা ভাববেন? আসুন, দুনিয়ার সবচেয়ে দামি কয়েকটি খাবার চিনে নেওয়া যাক। মনে রাখবেন, প্রতিটি খাবারই অত্যন্ত দুষ্প্রাপ্য, আর সেই কারণেই তার দাম এত বেশি।
জাফরান
জাফরানকে ‘লাল সোনা’ বলে ডাকা হয়, কারণ এর দাম সত্যিই সোনার সঙ্গে পাল্লা দেয়। ক্রোকাস গোত্রের একটি বেগুনি রঙের ফুল ফোটে পৃথিবীর হাতে গোনা কয়েকটি উপত্যকায়, জাফরান হচ্ছে তার পরাগ। ফুল পূর্ণ বিকশিত না হলে পরাগ বের করা যায় না, আর হেমন্তকালের মাত্র দু’টি সপ্তাহে এই ফুল ফুটে ওঠে তার সব ঐশ্বর্য নিয়ে।
মজাটা হচ্ছে, জাফরানের ফুলের চাষ থেকে আরম্ভ করে জমি থেকে তা তোলা, পরাগ আলাদা করা কোনওটাই মেশিনে করা যায় না, খুব সাবধানে হাতে করতে হয়। সাধারণত মহিলা শ্রমিকরাই এই সূক্ষ্ম কাজের দায়িত্ব পান। এক কেজি জাফরান বের করতে গেলে অন্তত লাখ চারেক ফুল লাগে। তা চাষ করতে লাগে দু’-দুটো বড়ো ফুটবল মাঠের সমান জমি!
ক্যাভিয়ার
ক্যাভিয়ার হচ্ছে স্টার্জন মাছের ডিমের আচার। তবে আমরা ভারতীয়েরা আচার বলতে যে মশলাদার বিষয়টি বুঝি, ক্যাভিয়ার ঠিক তা নয়। মাছের ডিম সংরক্ষণ করে রাখার জন্য একেবারে বেসিক পদ্ধতির আশ্রয় নেওয়া হয়। কাস্পিয়ান সাগর আর কৃষ্ণ সাগরে বেলুগা নামের একটি প্রজাতির স্টার্জন পাওয়া যায়, তার ডিম থেকে সেরা ক্যাভিয়ার তৈরি হয়। তবে বেলুগা স্টার্জন বিলুপ্ত হওয়ার মুখে – তার ডিমও খোলা বাজারে বিক্রি প্রায় বন্ধ।
চোরাগোপ্তা শিকার হয় বলেই ক্যাভিয়ারের দামের কোনও হিসেব থাকে না। অ্যালবিনো স্টার্জনের ডিমের চাহিদা ছিল সবচেয়ে বেশি – লুকিয়ে শিকার করতে গিয়ে প্রায় লুপ্তই হয়ে গিয়েছে এই প্রজাতির মাছ। জানেন কি, স্টার্জন মাছ পরিণত হয়ে ডিম পাড়ার অবস্থায় যেতে সময় লাগে অন্তত ২০ বছর? গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ড অনুযায়ী, পৃথিবীর সব চাইতে দামি ক্যাভিয়ার বিক্রি হয়েছিল ৩৪,৫০০ ডলার/ প্রতি কিলোগ্রাম মূল্যে। সেটি পাওয়া গিয়েছিল আন্দাজ ১০০ বছর বয়সি একটি অ্যালবিনো বেলুগা স্টার্জন থেকে।
অয়েস্টার
অয়েস্টার বা ঝিনুক এখন অতি ধনী ব্যক্তিদের পছন্দের খাবার হয়ে দাঁড়িয়েছে বটে, কিন্তু কয়েক দশক আগেও পৃথিবীর অজস্র সমুদ্রসৈকতে ঢেলে বিক্রি হত ঝিনুক বা অয়েস্টার। তার পর বাজারে রটে গেল যে, অয়েস্টার অ্যাফ্রোডিসিয়াক হিসেবে সেরা এবং যৌনক্ষমতা বাড়ায় – ফলে চাহিদা বাড়ল তার। প্রচুর শিকার হওয়ার পাশাপাশি সমুদ্রদূষণের ফলেও অয়েস্টার ক্রমশ কমে যাচ্ছে।
কোপি লুয়াক কফি
কোপি লুয়াক কফির এক কেজির দাম ৭০০-৮০০ ডলার, আর যদি সেটা জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করা হয়, তা হলে দাম চড়ে যেতে পারে ১৩০০-১৪০০ ডলারেও। না, এখনই অবাক হবেন না, আরও একটু ধৈর্য ধরুন। কোপি লুয়াক তৈরি হয় মূলত ইন্দোনেশিয়া আর ফিলিপিনসে। এক ধরনের ভাম বেড়াল আছে, যারা বিশেষ এক প্রজাতির জংলি কফির ফল খায়, তার পুরোটা হজম করতে পারে না, মল ত্যাগ করে। সেই মলের মধ্যে থেকে অর্ধেক হজম হওয়া কফি বিন বের করে বিশেষভাবে তৈরি করা হয় এই কফি।
কোপি লুয়াক নাকি স্বাদ আর গন্ধের দিক থেকে অতুলনীয়। এক সময় জঙ্গল থেকেই এই মল সংগ্রহ করতেন আদিবাসীরা, এখন এই ভাম খাঁচায় রেখে চাষ করা হয়। তা নিয়েও নানা বিতর্ক আছে – বলা হয় জোর করে নাকি তাদের কফির ফল খাওয়ানো হয়, রাখা হয় অত্যন্ত খারাপ পরিবেশে, তাতে কমে তাদের আয়ু। কিন্তু এতে কোপি লুয়াকের জনপ্রিয়তা কমেনি একটুও, বরং দিন দিন বাড়ছে।
ইবেরিকো হ্যাম
স্পেন আর পর্তুগালের হাতে গোনা কয়েকটি খামারে তৈরি হয় এই বিশেষ প্রজাতির হ্যাম। শুয়োর পালন করতে সময় লাগে তিন বছর, তার পর তার থেকে হ্যাম তৈরিতে সময় যায় ছ’ বছর! খাঁটি ইবেরিয়ান রক্তের শুয়োর ছাড়া এই হ্যাম তৈরি হবে না, তাই বিশুদ্ধ রক্তের পশুর চাষ করা হয় যত্ন নিয়ে। ওকের বনে ঘুরে বেড়ায় প্রাণীগুলি, খায় স্রেফ অরগ্যানিকভাবে সংগ্রহ করা পাইনের ফল আর জলপাই।
শেষ কয়েক সপ্তাহে স্রেফ অ্যাকর্ন খাওয়াই রীতি, সেই সঙ্গে মনের ইচ্ছেমতো পশুকে চরতে দেওয়া হয় পাইনের বনে। তাতে মাংসের স্বাদ খোলে। এই হ্যাম কেনার পর কীভাবে সংরক্ষিত হচ্ছে তাও গুরুত্বপূর্ণ, তার উপরেই নির্ভর করে স্বাদ। ভারতীয় মুদ্রায় এক কেজি ইবেরিকো হ্যামের দাম পড়তে পারে ১০০০০ টাকার কাছাকাছি।
সাদা ট্রাফল
ট্রাফল এমনিতেই দুষ্প্রাপ্য, তার মধ্যে আবার সাদা ট্রাফল তো পাওয়াই যায় না। ট্রাফল এক ধরনের মাশরুম, একটা গন্ধ থাকে, সেটাই তার মূল আকর্ষণ। চকোলেট বা পাস্তার স্বাদ বাড়াতে ট্রাফলের জুড়ি নেই। সাদা ট্রাফল চাষ করাও যায় না, তা জন্মায় বিশেষ এক ধরনের গাছের গোড়ায় – সেই গাছ আবার মেলে উত্তর ইতালির পিয়েডমন্ট অঞ্চলে। জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে খুঁজে বের করতে হয়, আবহাওয়ায় সামান্য তারতম্য হলে সব বছর জন্মায়ও না। তাই এর দাম হয় আকাশছোঁয়া।
ম্যাকাওয়ের ক্যাসিনো মালিক স্ট্যানলি হো ২০০৭ সালে ১.৫ কেজির একটি সাদা ট্রাফল কিনেছিলেন ৩ লক্ষ ৩০ হাজার ডলার দিয়ে – তাঁর এই মহান কীর্তি অমর হয়ে আছে গিনেস বুকের পাতায়।