কাজের দুনিয়ায় মেয়েরা পা রেখেছেন বহুদিন। কিন্তু তাঁদের সম্মানের আসনে কি জায়গা দিতে পেরেছে আমাদের সমাজ? সারা দুনিয়া জুড়ে এ প্রশ্ন বার বার উঠেছে গত কয়েক বছরে। ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়েছে অভিযোগ, কাঠগড়ায় উঠেছেন অজস্র নামী-দামি পুরুষ। মেয়েরা একযোগে গলা মিলিয়েছেন, হেরে যাননি।
এই #MeToo আন্দোলনের ঝড় থেকে বাদ পড়েনি আমাদের দেশও। তেমনই একটি হাই-প্রোফাইল মামলার রায় দিয়েছে হাইকোর্ট। উঠে এসেছে বেশ কিছু জরুরি প্রশ্ন। মামলার নিষ্পত্তি এখনও হয়নি, আবেদনকারী এই রায়ে খুশি নন স্বাভাবিকভাবেই – সম্ভবত আপিল করবেন তিনি। কিন্তু দিল্লি হাইকোর্টের রায়ে যে মূল বিষয়গুলি স্পষ্টভাবে সামনে এসেছে, তা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
২০১৭ সালে অফিসে যৌন হেনস্থা নিয়ে একটি ব্যক্তিগত কলাম লিখেছিলেন সাংবাদিক প্রিয়া রামানি, তাতে ধরা পড়েছিল কীভাবে নামজাদা এক সংস্থায় চাকরি করার সময়ে তখনকার বস এম জে আকবরের অত্যাচারের শিকার হয়েছিলেন তিনি। তাঁর এই বক্তব্যকে সমর্থন জানিয়ে আরও কয়েকজন মহিলা সাংবাদিক ওই প্রভাবশালী সম্পাদক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের দিকে অভিযোগের আঙুল তোলেন ও নিজের নিজের অভিজ্ঞতার কথা লেখেন সোশাল মিডিয়ায়।
আকবর পুরো বিষয়টি অস্বীকার করেন, বলেন এ সবের কোনওটাই তাঁর স্মৃতিতে নেই। এত বছর পর তাঁর তারকাসুলভ ইমেজ কালিমালিপ্ত করার উদ্দেশ্য নিয়ে একদল প্রাক্তন অধস্থন ষড়যন্ত্র করছেন। তিনি মানহানির মামলা করেন প্রিয়ার বিরুদ্ধে।
# সেই মামলার রায় দিতে গিয়ে আদালত প্রিয়াকে মানহানির অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন। সেই সঙ্গে স্পষ্ট জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন আগে ঘটা যৌন হেনস্থা প্রমাণ করা সম্ভব নয়, তা ছাড়া এ সব ঘটনার বেশিভাগটাই ঘটে বন্ধ দরজার আড়ালে। কেউ সাক্ষ্যপ্রমাণ রাখতে চাইলেও রাখা সম্ভব নয়।
# আকবর তাঁর আবেদনে বলেছিলেন, এই অভিযোগ তাঁর তারকাসুলভ ভাবমূর্তিতে কালিমা লেপন করেছে। আদালতের বক্তব্য, একজন মহিলার মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে সম্মান নিশ্চিত করা যায় না। রামানির বক্তব্য ছিল, যে মুহূর্তে একাধিক মহিলা আকবরের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন, সেই মুহূর্তেই সম্মান হারিয়েছেন তিনি। আদালত এই বক্তব্য মেনেও নিয়েছেন।
# প্রশ্ন উঠেছিল, এত বছর পর কেন মুখ খুলেছেন এতজন মহিলা? কেন তাঁরা তখনই ভদ্রলোকের বিরুদ্ধে নালিশ করেননি? আদালতের বক্তব্য, দেরিতে হলেও মহিলারা অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন, এটাই অনেক বড়ো। এই অপরাধে তাঁদের শাস্তি দেওয়া যায় না। তা ছাড়া, প্রিয়া যখনকার কথা বলছেন, তখন ১৯৯৩ সাল, মেয়েদের যৌন হেনস্থা ঠেকাতে ‘বিশাখা কমিশন’ গড়ে তোলা হয় তার অন্ত ১৭ বছর পর। তখনই অভিযোগ করলেও তিনি হালে পানি পেতেন না।
# আজ মেয়েরা মুখ খুলছেন বটে, কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে ‘সিস্টেমেটিক অ্যাবিউস অ্যাট ওয়ার্কপ্লেস’ চলে আসছে। #MeToo আন্দোলনের জেরে মেয়েরা প্রকাশ্যে সব কথা বলার সাহস পেয়েছেন। যৌন হেনস্থার বিরুদ্ধে যে কোনও সময় সরব হতে পারেন মহিলারা, তাঁদের বিশ্বাস করতে হবে। সেই সঙ্গে তাঁরা যে কোনও প্ল্যাটফর্মে নিজেদের অভিজ্ঞতা জানাতে পারেন – সেটাকেই মান্যতা দিতে হবে।
# যৌন হেনস্থাকারীকে আলাদা করে চেনার উপায় নেই, আর পাঁচজন স্বাভাবিক, সংসারী মানুষের সঙ্গে তাঁর কোনও ফারাক থাকে না। সন্তান, সংসার থাকলে বা সামাজিক প্রতিপত্তি থাকলেই যে তিনি নারী নিগ্রহ করবেন না, তেমনটা ধরে নেওয়া উচিত নয়।
# যৌন হেনস্থা মহিলার সম্মান কেড়ে নেয়, তাঁর আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি আসে। অনেকে বুঝতেই পারেন না যে তিনি যৌন হেনস্থার শিকার হয়েছেন, কেউ কেউ তা নিজের দোষ ভেবে মরমে মরে থাকেন। তাই এই ধরনের বেশিরভাগ কেস প্রকাশ্যে আসেই না।
# নির্যাতিতা বহু অসম্মান, আত্মগ্লানি সহ্য করার পর যখন আত্মরক্ষার সিদ্ধান্ত নেন, তখনই যৌন হেনস্থাকারীর চরিত্রহনন হয়। কিন্তু তার আগেই তিনি যে অপরাধটি করেছেন, তার ফলে মহিলাকে বহুদিন ভুগতে হয়েছে। আত্মরক্ষার অধিকার সব মানুষের আছে।
আদালতের রায় প্রিয়ার বিরুদ্ধে গেলে এবং আকবর তাঁর মানহানি প্রমাণ করতে পারলে সত্যিই মেয়েরা পিছিয়ে যেতেন কয়েক দশক। যৌন হেনস্থা যাঁরা করেন, তাঁদের আত্মবিশ্বাস একটা সময়ের পর তুঙ্গে পৌঁছে যায়। কেউ মুখ খোলার সাহস পাবে না, এটা ধরে নিয়েই একের পর এক অন্যায় হতে থাকে। বিপক্ষে আকবরের মতো স্বনামধন্য, ক্ষমতাশালী কেউ থাকলে তো আর কথাই নেই! তাই এ হেন সিদ্ধান্তে এ দেশের মেয়েরা যারপরনাই খুশি!