সারা পৃথিবীতে পরিবেশ নিয়ে যাঁরা একেবারে তৃণমূল স্তরে কাজ করেন, তাঁদের মধ্যে থেকে ছ’জনকে বেছে নিয়ে গোল্ডম্যান এনভায়রনমেন্টাল প্রাইজ দেওয়া হয় প্রতি বছর। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখা যাক, এই পুরস্কারটি গ্রিন নোবেল হিসেবেও খ্যাত। এ বছরের বিজেতাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত নামটি হল নেমোন্তে নেনকিমো। ইকুয়েডরের ওয়াওরানি জনজাতির এই নেত্রীর প্রচেষ্টায় সম্প্রতি রক্ষা পেয়েছে সে দেশের ৫,০০,০০০ একর বর্ষাবন।
ইকুয়েডরের বর্ষাবনের নিচে লুকিয়ে আছে খনিজ তেলের বিরাট ভান্ডার। সে দেশের সরকার প্রায়শই বর্ষাবন বেচে দেয় বেসরকারি সংস্থাকে, উচ্ছেদ হয় আদিবাসীরা। উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে তারা জঙ্গল কেটে শহর বানায়, তেলের খনিতে চাকরি পায়। তার পর ভেসে যায় মদ-জুয়ার নেশায়, হারিয়ে যায় জনজাতির নিজস্বতা। নেমোন্তে তাঁর নিজের পরিবারেই এমনটা ঘটতে দেখেছেন। তাই ওয়ারানি জনজাতির বাসভূমিতেও যখন উচ্ছেদের নোটিস এল, তখন রুখে দাঁড়ালেন এই নেত্রী।
এক সময়ে কনভেন্ট স্কুলে পড়তে গিয়েছিলেন এই তরুণী, কিন্তু বুঝতে পারেন, মিশনারি শিক্ষা তাঁর নিজস্বতাকে গলা টিপে মারবে। তাই ফিরে আসেন জঙ্গলে। এমনিতে ওয়াওরানিরা মাতৃতান্ত্রিক, মেয়েরাই সিদ্ধান্ত নেন, নেতৃত্ব দেন দলের। পুরুষদের কাজ যুদ্ধে জিতে আসা। তার উপর নেমোন্তের বাবা, দাদুও ছিলেন দলনেতা। তাই নেত্রী হিসেবে তাঁকেই বেছে নেন এই জনজাতির হাজার পাঁচেক মানুষ। সরকারের সঙ্গে লড়াই তখন দরজায় কড়া নাড়ছে।
ওয়াওরানিদের কাছে বর্ষাবনের গুরুত্ব অসীম। জঙ্গলকে রক্ষা করা নিজেদের পবিত্র কর্তব্য বলে মনে করেন তাঁরা। পূর্বপুরুষদের প্রাক্তন বাসস্থানের দশ ভাগের এক ভাগমাত্র এখন তাঁদের দখলে আছে। সেখান থেকেও উচ্ছেদ হতে হবে শুনে সরকারের বিরুদ্ধে তাঁরা মামলা ঠোকেন ২০১৮ সালে। আইনি লড়াইয়ের শেষে পিছু হঠতে হয় সরকারকে। সে দেশের শীর্ষ আদালত রায় দেন সরকারের বিপক্ষে। সেই সঙ্গে নিশ্চিত হয় আরও একটি বিষয়, ভবিষ্যতে কখনও জঙ্গলে কোনও কাজ করতে গেলে সেখানকার জনজাতিদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে সরকারকে এবং তাঁদের অনিচ্ছা থাকলে কোনও প্রজেক্ট নিয়ে এগনো যাবে না।
আইনি লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেন নেমোন্তে ও তাঁর সংস্থা সেইবো অ্যালায়েন্স। ‘আওয়ার রেনফরেস্ট ইজ নট ফর সেল’ ডিজিটাল ক্যাম্পেন শুরু করেন তাঁরা, গোটা দুনিয়া থেকে সই সংগ্রহ শুরু হয়। তবে এত সব হওয়ার পরেও অবশ্য সরকারের তরফে গা ছাড়া ভাব বজায় আছেই। এর মধ্যেই পুরস্কারের ঘোষণা হয়েছে, প্রচারের আলো পড়েছে নেমোন্তে ও ওয়াওরানিদের উপর। বর্ষাবনকে পৃথিবীর ফুসফুস বলা হয়। তা যে খুব দ্রুতহারে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, তা নিয়েও কোনও সন্দেহ নেই। এই অবস্থায় গ্রিন নোবেল এই আদি বাসিন্দাদের লড়াইয়ের নতুন উদ্যম দিয়েছে।
নেমোন্তে এখনও জঙ্গলেই থাকেন, সনাতন পোশাকে হাতে বর্শা নিয়ে হাজির হতেন কোর্টরুমেও। বলেন, “আমার বাড়ি যেখানে, সেখান থেকে সন্ধেবেলা কেবল আকাশের তারা দেখা যায় – আর কিছু না। আমাদের কাছে শব্দ বলতে পশুপাখির ডাক। শহরে যে মানুষ অত আওয়াজে কীভাবে থাকে, বুঝতে পারি না বাবা! তবে এই পুরস্কার পাওয়ার পর বাইরের লোক বুঝবে যে আমরা পৃথিবীর ভালোর জন্য কাজ করছি – সেটা ভেবে ভালো লাগছে।”
ফোটো: ইনস্টাগ্রাম