এতদিন নিয়ম ছিল প্রতিকূল পরিবেশে বন্ধ রাখা হবে জাতীয় অভয়ারণ্যগুলি। ভারত যেহেতু একটা বিরাট বড়ো দেশ এবং সেখানকার জীববৈচিত্রও বিপুল, তাই সব জাতীয় উদ্যান এক সময়ে বন্ধ হয় না। অনেকে মনে করেন, বর্ষাকালে বাঘের প্রজনন হয় বলে জাতীয় উদ্যান বন্ধ থাকে – সেটাও ঠিক না। বাঘের প্রজনন সারা বছর ধরেই হয়, করবেটের হাতির প্রজননের সময় হচ্ছে মে মাস। তবে অন্য নানা প্রাণির প্রজননকাল হচ্ছে বর্ষা।
উত্তর ও মধ্য ভারতে যেহেতু বর্ষাকালের আবহাওয়া খুব একটা পর্যটক-বান্ধব থাকে না, তাই এই অঞ্চলের সব জাতীয় উদ্যান বন্ধ রাখা হত ১৫ জুলাই থেকে ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত। আবহাওয়া ভালো থাকে বলে কোনও কোনও জঙ্গল অক্টোবর মাসেও খুলে যায়। কর্নাটকের নাগারহোল আর বান্দিপুর জাতীয় উদ্যান বন্ধ থাকে গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহে, কাজিরাঙ্গা আর মানস তো মে মাস থেকে অক্টোবর পর্যন্ত অগম্য হয়ে থাকে – পার্কের অনেক অংশ জলের তলায় ডুবে যায়। রণথম্ভোর খোলা থাকে অক্টোবর থেকে জুন পর্যন্ত। সুন্দরবনের জলপথ মোটামুটি সারা বছরই খোলা থাকে।
এই অবস্থায় উত্তরাখণ্ড সরকার ঠিক করেছে, তাদের দু’টি জাতীয় উদ্যান, রাজাজি আর করবেট সারা বছরই খোলা রাখা হবে পর্যটকের জন্য। কোভিডের দাপটে এমনিতেই সে রাজ্যে পর্যটনের নাভিশ্বাস উঠে গিয়েছে। চুক্তির ভিত্তিতে নিযুক্ত অস্থায়ী ট্যুর গাইডদের কাজ নেই দুই মরশুম, পার্কের আশে-পাশে থাকা খাবারের দোকান, হোটেল ব্যবসায়ীদেরও মাথায় হাত। ট্যুরিস্ট এলে পরিস্থিতি শুধরোবে বলে ধারণা সরকারের।
আর সেখান থেকেই তৈরি হয়েছে বিতর্ক। করবেটের বর্ষাকাল মোটেই সুখকর না, সরু তিরতিরে পাহাড়ি নালাও তীব্র বৃষ্টিতে ফুলে-ফেঁপে ওঠে। আগাছা, লতায় ছেয়ে যায় জঙ্গল। বেশি বৃষ্টি হলে করবেট ন্যাশনাল পার্কের ভিতরের থাকার জায়গাগুলোয় পর্যন্ত পৌঁছনো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়, রাস্তা আর কালভার্ট ভাঙে কারণ পাহাড়ি নালায় জলের সঙ্গে ভেসে আসে বড়ো বড়ো বোল্ডার।
করবেট জঙ্গলের একেবারে বাইরের দিকে ঝিরনা রেঞ্জ, সেটা খোলা থাকে সারা বছরই। ২০১৯ সালে সেখানেই পর্যটকদের গাড়ি ভাসিয়ে দিয়েছিল বৃষ্টির জলে ফুলে-ফেঁপে ওঠা একটি নালা। রাস্তা ডুবে গেলে বনরক্ষীরা হাতির পিঠে চেপে পেট্রোলিংয়ের কাজ সারেন। সেখানে ভারী বৃষ্টি হলে জিপ সাফারি হবে কীভাবে? পর্যটকরাই বা জঙ্গলের সৌন্দর্য উপভোগ করবেন কেমন করে? ভারী বৃষ্টিতে রাস্তাঘাট অগম্য হলে আগে থেকে বুক করে রাখা সাফারির টাকা ফেরত দেওয়া হবে কি? উত্তরাখণ্ড সরকার কিন্তু এখনও পরিষ্কার করে কোনও নিয়ম তৈরি করেনি।
মধ্যপ্রদেশে বান্ধবগড় ও কানহার বন্যপ্রাণিদের উপর চালানো একটি সমীক্ষায় স্পষ্ট দেখা গিয়েছে, যে সব ঋতুতে সাফারি বন্ধ থাকে, সে সময়ে বন্যপ্রাণীদের স্ট্রেস কম হয়। না হলে পর্যটকদের গাড়ির শব্দ, তেলের ধোঁওয়া প্রাণীদের খুব বিরক্ত করে। বর্ষার নিরুপদ্রব সময়টুকু তাদের স্বাস্থ্যের জন্যেও একান্ত প্রয়োজনীয়।
একদল বিশেষজ্ঞের আশঙ্কা, সারা বছর করবেট আর রাজাজি খোলা থাকলে মানুষ-পশুর সম্পর্কের অবনতি হবে, পশুরা আরও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতেও পারে। কিন্তু আমাদের দেশে পশুর অধিকার নিয়ে তেমন কোনও আইন নেই, নেই তাদের সুরক্ষার ব্যবস্থাও।
(ফোটো প্রতিনিধিত্বমূলক, বান্ধবগড় ন্যাশনাল পার্কে তুলেছেন রুদ্ররাজ ভট্টাচার্য)