রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবসম্পদ বিভাগের সমীক্ষা বলছে, দুনিয়ার প্রতি ৯৫ জন মানুষের মধ্যে একজন তার পূর্বপুরুষের বাসস্থান থেকে কোনও না কোনওভাবে উৎখাত হয়েছে। তবে এই সমীক্ষা কিন্তু কয়েক বছরের পুরোনো, কোভিড পরিস্থিতিতে তো আর এসব কাজ চালানো যায়নি!
তারই মধ্যে বিশ্ব দেখল আফগানিস্তানের সমস্যা, মানুষ স্রেফ প্রাণটুকু হাতে নিয়ে পালাচ্ছে কোনওভাবে। কিন্তু তার পর? পালিয়ে যাবেটা কোথায়? বেশিরভাগই তো কপর্দকহীন — সব গিয়েছে, স্রেফ হৃদপিণ্ডের ধুকপুকুনি ছাড়া – বাঁচবে কীভাবে তারা?
রাষ্ট্রপুঞ্জের রিফিউজি এজেন্সির সরকারি হিসেব অনুযায়ী, বিশ্বের অন্তত ৮৩ মিলিয়ন মানুষ নানা কারণে ভিটেহারা হয়েছে গত এক দশকে। কারণগুলির মধ্যে আছে প্রকৃতির রোষ, খাদ্যাভাব, অর্থসঙ্কট। তবে রাজনৈতিক হানাহানি, যুদ্ধ বা গণহত্যা থেকে পালানোর প্রচেষ্টায় প্রাণ হাতে ঘর ছেড়েছে সবচেয়ে বেশি মানুষ।
এদের মধ্যে রিফিউজি বা শরণার্থীর সংখ্যা ২৬.৪ মিলিয়ন, এদের অর্ধেকের বয়স ১৮-র কম। রিফিউজিরা কিন্তু আর কখনও দেশে ফিরতে পারে না – স্বদেশের ধারণাটাই বদলে ফেলতে হয় তাদের। ভিটেমাটি হারিয়ে কোনও দেশে গিয়ে পৌঁছনোর পর সেখানকার সরকারের কাছ থেকে তারা রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করে, সেটা সরকার না দেওয়া পর্যন্ত তাদের ‘অ্যাসাইলাম সিকার’ বলা হয়। রাজনৈতিক আশ্রয় না পেলে কিন্তু মানুষটি অনুপ্রবেশকারী হিসেবে বিবেচিত হবে।
এই অবস্থায় তাদের রক্ষা করার জন্য আন্তর্জাতিক রিফিউজি আইন আছে – যে দেশে তারা আশ্রয় প্রার্থনা করেছে, সেখান থেকে শরণার্থীদের ফেলে আসা দেশে জোর করে পাঠানো যায় না। সেই সঙ্গে তাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, স্বাধীনভাবে চলাফেরার অধিকারও সুনিশ্চিত করতে হয় আশ্রয়দাতা দেশকে।
তবে এগুলি সবই খাতা-কলমের নিয়ম, মায়ানমার থেকে তাড়া খেয়ে আসা রোহিঙ্গাদের নিয়ে ঠিক কী হচ্ছে, তা আমরা সবাই দেখতে পাচ্ছি। সমস্যা হচ্ছে, আইনি উপায়ে শরণার্থী হতে চেয়ে আবেদন করে খুব কম মানুষ, বেশিরভাগেরই বৈধ কাগজপত্র থাকে না, তারা রয়ে যায় অজ্ঞাতপরিচয় হিসেবেই। এদের জীবনে অনিশ্চয়তা বেশি, সামাজিক নিরাপত্তা নেই — তারা এক দেশ থেকে আর এক দেশে ভেসে বেড়ায় সারা জীবন।
গত কয়েক দশকে মূলত বিশ্বের ৫টি দেশ থেকে সর্বাধিক শরণার্থী ছড়িয়ে পড়েছেন নানা দিকে, দেশগুলি হল – সিরিয়া, ভেনেজুয়েলা, আফগানিস্তান, দক্ষিণ সুদান আর মায়ানমার। সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেটের হাত থেকে বাঁচতে লাখো মানুষ সমুদ্র পেরিয়ে যাত্রা করেছিল ইউরোপের দিকে। গ্রিস, জার্মানি, তুরস্ক ভরে গিয়েছিল সিরিয়ান শরণার্থীতে।
জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল সমস্যার গোড়ায় খুব ঔদার্য দেখিয়েছিলেন, প্রচুর সিরিয়ানকে ঠাঁই দিয়েছিল জার্মানি। পিছিয়ে ছিল না অস্ট্রিয়াও। একইভাবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু এখন তাঁরা এই বিপুল জনসংখ্যার চাপে ঘরে-বাইরে নানা সমালোচনার মুখে দাঁড়িয়ে – ফলত আফগান রিফিউজিদের বুকে টেনে নেওয়ার মতো দেশ বিরল।
আফগানিস্তানে বছরের গোড়া থেকে রাজনৈতিক সমস্যা শুরু হওয়া ইস্তক সপ্তাহে ২০-৩০ হাজার মানুষ দেশ ছেড়েছে। সবাই কম-বেশি বিত্তবান, বৈধ কাগজপত্র ছিল, অন্য দেশে আত্মীয়-বন্ধু থাকাও বিচিত্র নয়। এরা যেখানে গিয়েছে, ভিসা নিয়ে গিয়েছে। চোরাপথেও ইউরোপের দিকে রওনা হয়েছে অনেকে, তুরস্কে গত মাসেই প্রায় ৩০,০০০ বেআইনি আফগান অনুপ্রবেশকারীকে ধরা হয়েছে, তারা ইরান সীমান্ত টপকে এসেছিল। লিথুয়ানিয়া, তাজিকিস্তান, বেলারুশেও চোরাপথে ঢুকছে বহু আফগান। গ্রিস তাদের স্থল ও জল সীমান্তে বসিয়েছে কড়া পাহারা।
আরও একটা সমস্যা হচ্ছে, এমন বহু আফগান গোটা ইউরোপে আছে, যারা অ্যাসাইলাম পায়নি – আবেদন বাতিল হয়েছে। তাদের কি এখন দেশে ফেরানো হবে? ফিরলে তালিবানের কঠোর শাস্তির মুখে পড়তে হবে না তো? এই আশঙ্কায় বহু আফগান খাতায়-কলমে আবেদনই করল না শরণার্থী হিসেবে, ভিড়ে লুকিয়ে কাটিয়ে দিল – এমনটাও হতে পারে!
শুধু তো কোনও দেশে থাকলে হবে না, খাওয়া-পরার জোগাড় করতে হবে। সেই করতে গিয়ে বাড়বে অপরাধ, এদের বাচ্চারা লেখাপড়া শিখবে না, স্বাস্থ্যের অধিকার পাবে না – এভাবে কি বেঁচে থাকা যায়? এর মধ্যে মহিলা, শিশু আর ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অবস্থা আরও খারাপ, কিন্তু তাদের নিয়ে আলাদা করে কথা বলার জায়গাতেই নেই কেউ!
আমেরিকার উপর আফগান শরণার্থীদের দায়িত্ব নেওয়ার চাপ বাড়ছে, কিন্তু সে সদিচ্ছা তাদের আছে কী? উত্তর নেই এ প্রশ্নেরও। আপাতত অসহায়ভাবে তাকিয়ে দেখা ছাড়া উপায় নেই!