বাড়ির কর্তা রোজগার করে নিয়ে আসেন, সুতরাং তিনি যা বলবেন সেই মতেই সংসার চলবে। কিন্তু যে গিন্নির ভরসায় বাড়ি ফিরে গরম খাবার জুটছে, বড়ো হচ্ছে সন্তান, যত্নে থাকছেন বয়স্ক মা-বাবা তিনি উঠতে বসতে খোঁটা শুনবেন – এমনটা আর চলবে না। অন্তত আইনের পরিভাষায়।
সুপ্রিম কোর্টের তিন বিচারক, জাস্টিস এন ভি রামানা, এস আব্দুল নাজির এবং সূর্য কান্ত সাম্প্রতিক এক রায়ে বলেছেন, সাধারণত পরিবারের মেয়েরা সংসারের কাঠামোটাকে অটুট রাখার জন্য জীবনের অনেকটা সময় ব্যয় করেন, বহু আত্মত্যাগ করেন। বাড়ি ও তার চারপাশ পরিষ্কার রাখা, কী বাজার বা রান্না হবে তার হিসেব করা, বাচ্চা ও বড়োদের দেখভাল করার পুরো দায়িত্ব তাঁরা নেন নিঃস্বার্থভাবে।
গ্রামের মেয়েরা তো তার পরে আবার চাষ-আবাদ বা পশুপালনের কাজেও স্বামীর সহায়তা করেন। সমস্যা হচ্ছে, এর কোনওটার বিনিময়েই পরিবারে অর্থের জোগান বাড়ে না। তাই তাঁদের এত দায়িত্ব নেওয়াটাকেও লঘু করে দেখা হয়। ঘর সামলানোটাকে কাজ নয়, দেখা হয় কর্তব্য হিসেবে!
বেঞ্চের প্রধান বিচারপতি রামানা বলেছেন, “এই ধরনের চিন্তাভাবনার মধ্যেই সমস্যা আছে এবং এবার তা বদলানো দরকার। মহিলাদের কাজের আনুমানিক মূল্য নির্ধারিত হবে এখন থেকে এবং তা গণনা করতে হবে জাতীয় আয়ের হিসেবের মধ্যে। কোনও জাতির অর্থনৈতিক উন্নতির একটা ব্যবহারিক আঙ্গিক থাকে – মেয়েদের পরিশ্রম ও পরিবার গড়ে তোলাটা হচ্ছে সেই দিক। পরিবার ছাড়া তো আর রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নতি সম্ভব নয়! মেয়েরা নিজেদের স্বার্থের কথা না ভেবে সংসারে শ্রম দিয়ে এসেছেন এতকাল, এবার রাষ্ট্রের কর্তব্য হচ্ছে তাঁদের প্রচেষ্টাকে সম্মানিত করা।”
এই প্রসঙ্গে কয়েকটি ইন্টারেস্টিং তথ্য জানিয়ে রাখা যাক। ২০১১ সালের জনগণনার হিসেব অনুযায়ী, প্রায় ১৬০ মিলিয়ন ভারতীয় মহিলা জানিয়েছিলেন, তাঁদের মূল পেশা হচ্ছে বাড়ির কাজ। মাত্র ৫.৭৯ মিলিয়ন পুরুষ ঘোষণা করেছিলেন যে তাঁরা বাড়ির দায়-দায়িত্ব সামলান।
২০১৯-এ ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিকাল অফিস ‘টাইম ইউজ ইন ইন্ডিয়া’ শীর্ষক একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। তাতে দেখা গিয়েছে, প্রতিদিন গড়ে একজন মহিলা ২৯৯ মিনিট সময় ব্যয় করেন ঘরের কাজে, পুরুষদের ক্ষেত্রে গড় হিসেব হচ্ছে ৯৭ মিনিট। বাড়ির সদস্যদের যত্নআত্তি করতে মেয়েদের দিনে ১৩৪ মিনিট অন্তত খরচ হয়, পুরুষরা ব্যয় করেন মাত্র ৭৬ মিনিট।
সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ ২০১৪ সালে দায়ের হওয়া একটি ক্ষতিপূরণের মামলার রায় দিতে গিয়ে বলেছে, “ভারতের বিচারবিভাগ মনে করে, গৃহকর্ত্রীর এই নিঃস্বার্থ পরিষেবা ও শ্রমের মূল্য অপরিসীম। নারী ও পুরষের মধ্যে কোনও বিভেদ নেই এবং সমাজের চোখে সবাই সমান।”
এবার প্রশ্ন, কীভাবে নির্ধারিত হবে গৃহকর্মের মূল্য? বিচারপতি রামানা তারও নির্দেশিকা দিয়েছেন। বাঁধাধরা কোনও নিয়ম থাকবে না, ক্ষেত্রবিশেষে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে আদালত সিদ্ধান্ত নেবে কোন নারীর গৃহকর্মের আর্থিক মূল্য কী হবে। “কাজটা নিঃসন্দেহে কঠিন, কারণ ভালোবাসা বা যত্নের হিসেব টাকায় করা যায় না – তা অমূল্য। তবে চেষ্টা করাটা জরুরি।”
এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখা যাক, ২০১৪ সালের এক সকালে স্কুটার চালিয়ে অফিস যাচ্ছিলেন দুই অপ্রাপ্তবয়স্ক কন্যার পিতা বিনোদ, সঙ্গে ছিলেন তাঁর গৃহবধূ স্ত্রী পুনম। পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় দম্পতির। মোটর অ্যাক্সিডেন্টস ক্লেম ট্রাইবুনাল তাঁদের জন্য ৪০.৭১ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ বরাদ্দ করে।
কিন্তু পরবর্তীকালে দিল্লি হাইকোর্ট ক্ষতিপূরণের পরিমাণ কমিয়ে ২২ লক্ষে নামায় – যুক্তি ছিল, পুনম গৃহবধূ। বেঁচে থাকলেও তিনি রোজগার করতেন না, তাই স্রেফ বিনোদের উপার্জনের সমান টাকাই পাবে তাঁর পরিবার। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে পুনর্বহাল হল আগের ক্ষতিপূরণ, উলটে ইনশিওরেন্স কোম্পানিকে এই রাশির উপর ৯ শতাংশ হারে সুদ দিতে হবে ২০১৪ সালের মে মাস থেকে।