পুজোর পরে খুলতে পারে স্কুল-কলেজের দরজা – এমন একটা আলোচনা সম্প্রতি শুরু হয়েছে সরকারি স্তরে। তারপর থেকেই কার্যত দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছেন অভিভাবকেরা। একদলের বক্তব্য, বাচ্চাদের টিকাকরণ শুরুই হল না, গোটা দেশের মাত্র ৮-৯% মানুষ টিকার আওতায় এসেছেন, এর মধ্যে বাচ্চাদের স্কুল খুলবে কোন আক্কেলে? বিশেষ করে যখন ঘাড়ের উপর তৃতীয় ওয়েভের আশঙ্কা?
দ্বিতীয় দল, যার মধ্যে রয়েছেন বহু মনোবিদ বলছেন, অল্পবয়সিদের কাছে স্কুল স্রেফ লেখাপড়া শেখার জায়গা নয়। সেখানে তারা সামাজিক হয়ে ওঠার বিদ্যে আয়ত্ব করে। সেই ২০২০-র ফেব্রুয়ারি মাসের পর থেকে পঠনপাঠন বন্ধ, বাচ্চারা বাড়িতে বন্দি, সমবয়সি কারও সান্নিধ্য পাচ্ছে না – এতে তাদের মনের উপর মারাত্মক চাপ পড়ছে। বাড়ছে স্কুলছুটের সংখ্যা। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাদের স্কুলে পাঠানো উচিত।
স্কুল কর্তৃপক্ষের অবস্থান অনেকটা শাঁখের করাতের মতো। কারণ —
. এই অবস্থায় স্কুল খোলা মানেই ঘাড়ে চাপবে স্যানিটাইজেশন-সহ অন্য নানা খরচের বিপুল ধাক্কা।
. বেসরকারি স্কুলে মাইনে বাড়ানোর কথাও বলা যাবে না – ব্যবস্থা করতে হবে নিজেদেরই।
. সব ছাত্রছাত্রী যেহেতু একসঙ্গে ক্লাসে আসতে পারবে না, তাই অনলাইন পঠনপাঠন চালু রাখতে হবে অথবা একই জিনিস বার বার পড়াতে হবে। তাতে সিলেবাস শেষ হবে কীভাবে?
. শিক্ষকদের উপর মারাত্মক চাপ তো পড়বেই, যে সব স্কুলে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বেশি, সেখানে পুরো ইনফ্রাস্ট্রাকচার ঢেলে সাজাতে হবে।
. স্কুল বাসের রক্ষণাবেক্ষণে বিরাট টাকা খরচ হয়েছে এ যাবৎ, তাও সেগুলির স্বাস্থ্যহানি হয়েছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না এখনই। যে বাসের বহনক্ষমতা ১০০, সেখানে এখন ৫০ জনকে আনা যাবে। এই অবস্থায় বাস চালানোর খরচ বাড়বে।
. থার্ড ওয়েভ এসে পড়লে সব বিফলে যাবে, ফের পুরোনো পঠনপাঠন পদ্ধতিতে ফিরে যেতে হবে।
এর উপর আছে সংক্রমণের আশঙ্কা। তবে এখানে বিজ্ঞানীরা কিছু এমন তথ্য দিচ্ছেন যা আশার আলো দেখাতে পারে। ইউরোপ ও আমেরিকায় বহু স্কুল খুলে গিয়েছে, সেকেন্ড ও থার্ড ওয়েভ চলাকালীনও ক্লাস হয়েছে, তা থেকে কিছু সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যায়।
২ আগস্ট আমেরিকার হোয়াইট হাউস একটি ফ্যাক্ট শিট বের করেছে, তাতে রয়েছে খুব জরুরি কয়েকটি পয়েন্ট। আমেরিকায় ফের সংক্রমণ বাড়ছে, তবে সেখানকার ৫০% নাগরিকের টিকাকরণ হয়ে গিয়েছে। স্কুলের শিক্ষক-অশিক্ষক কর্মচারীদের ৯০%-এর বেশি এসে গিয়েছেন ভ্যাকসিনেশনের আওতায়। তাই সেখানে স্কুলও খোলা। বিজ্ঞানীদের ধারণা, আশপাশে থাকা বড়োদের টিকা নেওয়া হয়ে গেলে বাচ্চাদের সংক্রমণের আশঙ্কা কমে।
বিবিসির রিপোর্ট অনুযায়ী, বড়োদের ভ্যাকসিনেশনের কাজ অনেকটা এগিয়ে যাওয়ার পর ইংল্যান্ডের বাচ্চারাও নিয়ম মেনে স্কুল করছে। সেখানে ১৬ আগস্টের পর থেকে বাচ্চাদের স্কুলে মাস্ক পরে থাকাও বাধ্যতামূলক নয়। তবে ভারতের ক্ষেত্রে এখনই এতটা ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। মাস্ক বাধ্যতামূলক রেখে বাচ্চাদের স্কুলে ফেরত আনার কথা ভাবা যেতে পারে।
সারা বিশ্বের নানা প্রান্তে হওয়া বহু স্টাডি প্রমাণ করেছে যে, বাচ্চারা সংক্রমণের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। পৃথিবীর যেখানে যেখানে বাচ্চারা স্কুলে গিয়েছে, সেখানে সংক্রমণ ছড়ানোর পর কনট্যাক্ট ট্রেসিং করে দেখা গিয়েছে যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্কুলে নয়, বাচ্চার ইনফেকশন হয়েছে বাইরে থেকে।
বাচ্চাকে নিয়ে যদি আপনি বাড়ির বাইরে বেরোন, শপিং মল বা রেস্তোরাঁয় যান, বেড়িয়ে আসেন আত্মীয়ের বাড়ি বা কাছে-পিঠের ট্যুরিস্ট স্পট থেকে, তা হলে তার স্কুলে যাওয়াটা আটকাবেন না। সংক্রমণের আশঙ্কা সর্বত্র আছে। সে মাস্ক পরুক, সাবধানতা বজায় রাখুক। দেখে নিন স্কুলে জানলা দরজা খোলা আছে কিনা – ভেন্টিলেশন যথাযথ হলে ইনফেকশনের আশঙ্কা কমে। এসি চালানো চলবে না। আপাতত ভিড়ে ঠাসা পুলড কারে বাচ্চাকে না পাঠানোই ভালো – কয়েকজন অভিভাবক পালা করে দায়িত্ব নিয়ে বাচ্চার স্কুল যাওয়া-আসার ব্যবস্থা করুন। তার মধ্যে টিকা এসে গেলে তো হয়েই গেল!
বার বার বহু বিজ্ঞানী বলেছেন যে বাচ্চাদের উপরেই নেমে আসবে তৃতীয় ওয়েভ, এ ধারণার সপক্ষে কোনও প্রমাণ মেলেনি। তাই সাবধানে থাকুন, আতঙ্কে ভুগবেন না।