ছোট্টবেলায় অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ক্ষীরের পুতুল আমরা অনেকেই পড়েছি। সে গল্পে বাণিজ্যে বেরোনো রাজার কাছে ছোটরানির বায়না ছিল ‘আকাশের মতো নীল, বাতাসের মতো হালকা আর জলের মতো চিকন শাড়ি’ এনে দেওয়ার! রূপকথার গল্পের সে শাড়ির সঙ্গে মিল খুঁজলে বাস্তবের একটি শাড়ির কথাই মনে পড়ে, সেটি মসলিন!
প্রায় ২০০ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া মসলিনের প্রতিটি বুননে লেখা ছিল প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্য আর কৃষ্টি। নানা গল্প প্রচলিত ছিল মসলিন নিয়ে। ঢাকাই মসলিন নাকি এতটাই মিহি ছিল যে আংটির মধ্যে দিয়ে গলে যেত, দেশলাইয়ের বাক্সে ঢুকে যেত একটা গোটা শাড়ি। চিনা পর্যটক হিউয়েন সাং মসলিনকে তুলনা করেছিলেন ভোরের মিহি কুয়াশার সঙ্গে!
এ হেন মসলিন বাংলা থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেল একদিন। শিল্পবিপ্লবের পর বিলিতি মিলের কাপড় বাংলায় বিক্রিযোগ্য করে তুলতে গায়ের জোরে মসলিন শিল্প বন্ধ করে দেয় ইংরেজ শাসক। ঢাকাই মসলিনের শেষ প্রদর্শনী হয়েছিল লন্ডনে ১৮৫০ সালে। তারপর থেকে চিরদিনের মতো হারিয়ে গিয়েছিল মসলিন।
কিন্তু ইদানীং ফের নতুনভাবে খবরের শিরোনামে ফিরে এসেছে মসলিন। বাংলাদেশের একদল গবেষক টানা ছ’ বছরের চেষ্টার পর ফের তৈরি করতে পেরেছেন ঐতিহ্যবাহী ঢাকাই মসলিন। তার জিআই স্বত্বও পেয়েছেন তাঁরা।
কীভাবে ফিরে এল বাংলার প্রাচীন এই শিল্প? ছয় গবেষকের প্রচেষ্টার কাহিনি কোনও সিনেমার গল্পের চেয়ে কম নয়! আসল মসলিন কাপড় কেমন দেখতে তা জানতে কলকাতা থেকে লন্ডন পর্যন্ত পাড়ি দিয়েছেন তাঁরা। তবে তারও আগে তাঁদের খুঁজে বের করতে হয়েছে যে তুলো থেকে সুতো কেটে মসলিন বোনা হত, সেই ফুটি কাপাস গাছ।
মসলিন শিল্প ধ্বংস করতে ফুটি কাপাসের চাষ বন্ধ করে দিয়েছিল ইংরেজ শাসকেরা, ফলে গাছটি একেবারে বিলুপ্ত হয়ে গেছে এই আশঙ্কা ছিল। বহু খোঁজাখুঁজির পির মোট ৩৮টি নমুনা ঘেঁটে গবেষকেরা একটি নমুনা পান যার সঙ্গে ফুটি কাপাসের মিল রয়েছে।
এবার এই ফুটি তুলোই সেই ফুটি তুলো কিনা বোঝা যাবে কী করে! লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়াম থেকে প্রাচীন ঢাকাই মসলিনের একটু নমুনা জোগাড় করেন গবেষকেরা। তার ডিএনএ আর সংগৃহীত কাপাস তুলোর ডিএনএ বিশ্লেষণ করে তাঁরা নিশ্চিত হন আসল ফুটি তুলোরই সন্ধান পাওয়া গেছে।
এর পর সুতো কাটার কাজ। বাংলাদেশের কুমিল্লার সুতোকাটনিদের বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে মসলিনের সুতো কাটার উপযোগী করে তোলা হয়। বানানো হয় বিশেষ ধরনের চরকা। সুতো কাটার সময় কাটনিদের আঙুলের বিশেষ যত্ন নিতে হয়েছে। নিয়মিত ক্রিম মেখে নরম রাখতে হয়েছে আঙুল। হাত ঘেমে গেলে লাগিয়েছেন পাউডার। সুতো কাটা চলাকালীন ওই হাতে আর কোনও কাটাকাটি বা ভারী কাজ করা বারণ ছিল কাটনিদের।
শেষ পর্যন্ত বহু পরিশ্রমের পর তৈরি হয়েছে ছ’টি মসলিন শাড়ি। একটি শাড়ি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উপহার দিয়েছেন গবেষকেরা। ছ’বছর ধরে চলতে থাকা এই প্রকল্পে খরচ হয়েছে প্রায় সোয়া চার কোটি টাকা।
তবে এই মসলিনকে আসল মসলিন বলতে রাজি হচ্ছেন না বয়নশিল্পের সঙ্গে যুক্ত বিশেষজ্ঞদের একাংশ। তাঁদের মতে, ফুটি তুলো আজকের দিনে পাওয়া অসম্ভব। যা পাওয়া যেতে পারে তা বড়জোর মিশরীয় বা আমেরিকান তুলোর প্রজাতি। কারণ মিহি ফুটি তুলোর চাষ ধ্বংস করে কৃষকদের তুলনায় মোটা মিশরীয় বা আমেরিকান তুলো চাষ করতে বাধ্য করেছিল শাসক ইংরেজ। ফলে সেই তুলো থেকে মিহি শাড়ি তৈরি করা গেলেও তা প্রকৃত মসলিন কিনা তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ থেকে যায়।
দ্বিতীয়ত, এই বিশেষজ্ঞদের মতে ঢাকাই মসলিন তৈরি করতে পরিবেশের একটা বড় ভূমিকা ছিল। বুড়িগঙ্গার ধারে ভোরের পাতলা কুয়াশার মধ্যে নাকি কাটতে হত মসলিনের সুতো, ভালো করে আলো ফোটার আগেই শেষ করতে হত সুতো কাটার কাজ। দুশো বছর আগেকার সেই পরিবেশ আজকের দিনে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব! তাই আসল মসলিন পাওয়াও দুরাশা!
আসল ঢাকাই মসলিন, না মিহি কাপড়, সে তর্ক আপাতত তোলা থাক। কারণ এই মুহূর্তে সাধারণের নাগালের মধ্যে নেই সে কাপড়ের দাম! একটা মাত্র কাপড় বুনতেই খরচ হয়েছে প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ টাকার বেশি। তবে আগামী দিনে দাম আরও খানিকটা কমতে পারে বলে আশা গবেষকদের!
দাম না হয় কমল! তাতেও কি আর আমার-আপনার নাগালে আসবে মসলিনের দাম? নাকি শেষ পর্যন্ত আকাশের মতো ফুরফুরে আর জলের মতো চিকন শাড়ি থেকে যাবে রূপকথার পাতায়? উত্তর দেবে সময়!
তথ্যসূত্র: বাংলাদেশের পত্রিকা প্রথম আলো