বেশিরভাগ মেয়েই প্রসাধনী ব্যবহার করেন, আজকাল ছেলেরা সাজগোজ করলেও সেদিকে বাঁকা চোখে তাকান না কেউ। কিন্তু এর পাশাপাশি অন্য এক ট্রেন্ডও শুরু হয়েছে সারা দুনিয়া জুড়ে। উপভোক্তারা বোঝার চেষ্টা করছেন, তাঁরা রোজের জীবনে যে সব প্রসাধনসামগ্রী ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন, সেগুলি থেকে পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে না তো?
এ কথা কিন্তু সত্যি যে প্রসাধন নির্মাতা সংস্থাগুলি বিভিন্ন প্রাণিজ উপাদান ব্যবহার করে তাদের প্রডাক্টে, তার জন্য মারা পড়ে বহু অবলা জীব। তা মানুষের ব্যবহারের জন্য নিরাপদ কিনা বোঝার জন্য বহু জন্তুর উপর প্রয়োগ করে দেখা হয়। ইঁদুর, বেড়াল, খরগোশের শরীরে তো আর প্রসাধন কোনও ম্যাজিক দেখায় না, পরীক্ষাগারের খাঁচায় আটকে মৃত্যুই তাদের ভবিতব্য হয়ে দাঁড়ায়।
সমুদ্রের তীরে বেড়াতে গিয়ে ত্বকের সুরক্ষার জন্য সানস্ক্রিন ব্যবহার করাটাই দস্তুর। কিন্তু সেই সানস্ক্রিনের অক্সিবেনজোন বা অকটিনক্সেট যে সমুদ্রের জলে মিশে প্রবাল প্রাচীর ধ্বংসের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে, সে তথ্য ব্যবহারকারীর কাছে এসে পৌঁছচ্ছে না।
কোকো বাটার বা শিয়া বাটারযুক্ত ক্রিম বা শ্যাম্পু যে ত্বকের জন্য খুব ভালো, তা নিয়ে নিশ্চয়ই আপনার কোনও সন্দেহ নেই? কিন্তু জানেন কি, আইভরি কোস্ট বা ঘানায় খুব সস্তা শিশু শ্রমিক দিয়ে কাজ করানো হয় কোকো বা শিয়া বাদামের বাগানে? আইশ্যাডো বা ব্লাশঅনে শিমারি এফেক্ট আনতে ব্যবহৃত হয় অভ্রের গুঁড়ো – সারা দুনিয়ার অভ্রখনির সঙ্গেই শিশু শ্রমের যোগ খুঁজে পাওয়া যায়।
অধিকাংশ ময়েশ্চরাইজারের বেস হিসেবে পাম তেল ব্যবহার করা হয়, আর বিশ্বের সর্বাধিক পাম তেল উৎপাদনকারী দেশের নাম ইন্দোনেশিয়া। সেখানেও ৮-১০ বছরের বাচ্চাদের দিয়ে কাজ করানো হয় তেল উৎপাদনের নানা পর্যায়ে। সেই সঙ্গে নির্বিচারে জঙ্গল ধ্বংস করে লাভদায়ক গাছের চাষ করা তো আছেই।
এই যে তেল, সাবান, শ্যাম্পু, কন্ডিশনার আপনি ব্যবহার করছেন, তার ফলে কি বিপুল বর্জ্য তৈরি হচ্ছে তা কখনও ভেবে দেখেছেন? বেশ কিছু বহুজাতিক সংস্থা কিন্তু ক্রেতার থেকে খালি বোতল সংগ্রহের ব্যবস্থা করেছে, সেই সঙ্গে চলছে রি-প্যাকেজিংয়ের কাজও। যে প্রডাক্ট আপনি কিনছেন, তার সাপ্লাই চেন সম্পর্কে একটু খোঁজখবর জেনে যাবেন তার কার্বন ফুটপ্রিন্টের মাত্রা ঠিক কী।
আপনি কি জানেন, আপনাকে সুন্দর করে তোলার জন্য কোন কোন প্রাণিজ উপাদান ব্যবহার করা হয়? যদি দেখেন লোশন/ময়েশ্চরাইজার, হেয়ার কেয়ার প্রডাক্ট, লিপস্টিক, লিপ বাম বা অ্যান্টি পার্সপিরান্টে ইউরিয়া বা কারবামাইড নামক উপাদান আছে, তা হলে জেনে রাখুন সেটি প্রাণির মূত্র থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।
আপনার লাল বা গোলাপি লিপস্টিক/ লিপবাম/ ব্লাশ অন বা আইশ্যাডোতে কি ন্যাচরাল রেড ফোর, কারমাইন, বা কারমিনিক অ্যাসিড নামক কোনও প্রডাক্টের উল্লেখ আছে? কোচিনিল নামক একটি গুবরে পোকা মেলে মধ্য আমেরিকায়, তারা বিশেষ এক ধরনের ক্যাকটাসের লাল ফল খায়। একটা সময়ের পর এই পোকাগুলিকে ক্যাকটাসের গা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে মেরে ফেলা হয়। তার পর শুকিয়ে গুঁড়ো করে বের করা হয় টুকটুকে লাল রঞ্জক।
চুলের যত্নের অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান কেরাটিন কীভাবে মেলে জানেন? প্রাণির হাড়, পালক আর খুর থেকে। মৃত প্রাণির হাড়, চামড়া, লিগামেন্ট থেকে সংগ্রহ করা হয় কোলাজেন বা জেলাটিন। বিশেষ ধরনের ভেড়ার ত্বক থেকে সংগৃহীত হয় ল্যানোলিন। মধু বা মোম সংগ্রহের জন্য মারা পড়ে বহু মৌমাছি।
সুবিধের দিকটা হচ্ছে, সারা দুনিয়ায় এ নিয়ে সচেতনতা তৈরি হচ্ছে ধীরে ধীরে, উপভোক্তারাও এমন প্রডাক্ট খুঁজছেন যাকে ‘এথিকাল’ আখ্যা দেওয়া যায়। তাঁরা কেনার আগে দেখে নিচ্ছেন প্রডাক্টটি পিটা সার্টিফায়েড, ভেগান, এথিকাল, অরগ্যানিক, রি-সাইকেলেবল প্যাকেজিংয়ের তকমা পেয়েছে কিনা।
তবে হ্যাঁ, এটাও ঠিক যে এত কিছু সাত-পাঁচ না ভেবেই বহু মানুষ সাজগোজ করেন। আপনিও তেমনটা করতেই পারেন – তাতে কারও আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু এমন অনেকেই আছেন যাঁরা স্রেফ উপভোক্তা নন, সচেতনভাবেই কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমাতে চান, বা অন্য পশুকে কষ্ট না দেওয়ার চেষ্টা করেন। তাঁদের জন্যও যে একটা রাস্তা তৈরি হচ্ছে, সেটাই বা মন্দ কী?