সাম্প্রতিক অতীতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নানা ওয়েলফেয়ার স্কিম প্রশংসা কুড়িয়েছে। সেই তালিকার একেবারে শীর্ষে আসবে ‘দুয়ারে সরকার’ প্রকল্পের নাম। বহু মানুষ তাঁদের অসুবিধে নিয়ে সরাসরি পৌঁছে গিয়েছেন বাড়ির কাছের কোনও না কোনও ক্যাম্পে।
প্রথমে এ প্রকল্পের কার্যকারিতা নিয়ে নানা মহলে সন্দেহ থাকলেও কার্যত দেখা গিয়েছে, মানুষের সমস্যার সুরাহা সত্যিই হচ্ছে। অমর্ত্য সেনের প্রতীচী ট্রাস্টের রিপোর্ট বলছে, দুয়ারে সরকার ক্যাম্পে তিন কোটির কাছাকাছি অভিযোগ জমা পড়েছে, সমস্যার সমাধান হয়েছে ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রে! ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের প্রশংসাও কুড়িয়েছে ‘দুয়ারে সরকার’।
পাশাপাশি মহিলাদের শক্তি বাড়াতে বা নাবালিকার বিয়ে ঠেকাতে ‘কন্যাশ্রী’, ‘রূপশ্রী’-ও খুব কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। UNDP, UNICEF- নানা সময়ে এই সব প্রকল্পের উল্লেখ করেছে। সাম্প্রতিককালে অবশ্য সব আকর্ষণের কেন্দ্রে রয়েছে ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’। ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের থেকে এই বাবদ ১২৫ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ পাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার, তা আগামীদিনে আরও বাড়তে পারে।
লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের সুবিধে পাওয়ার জন্য ‘দুয়ারে সরকার’ ক্যাম্পে গিয়ে নাম লেখাতে হবে বাড়ির মহিলাদের। যাঁদের নামে স্বাস্থ্যসাথী কার্ড আছে, তাঁদের সুবিধে হবে। ফর্ম যথাযথভাবে পূরণ করে জমা দিলে বাড়ির মহিলার অ্যাকাউন্টে মাসে ৫০০ টাকা ট্রান্সফার করে দেওয়া হবে সরাসরি। পরিবারে সরকারি চাকরিজীবী থাকলে এ সুবিধে মিলবে না, সরকারি পেনশনভোগী পরিবারের ক্ষেত্রেও এই সুবিধে দেওয়া হবে না।
প্রকল্পটিকে যথাসম্ভব স্বচ্ছ রাখার জন্য আধার কার্ডের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। সুবিধে পাবেন কেবল গৃহকর্ত্রী। তবে তার পরেও যে বহু নকল আবেদনপত্র জমা পড়বে এবং মানুষ অন্যায্য সুবিধে নেবেন, সে বিষয়ে নিশ্চিত থাকা যায়। তবে তার দায় আমার-আপনার – আমাদের অনৈতিকতা আর লোভের জন্য সরকার কেন দায়ী হতে যাবে?
অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, এভাবে টাকা বিলিয়ে বেড়ানোর অর্থ কী? তাঁদের কয়েকটি কথা বিশেষভাবে জানানো দরকার।
১. কোনও সরকারই কারণ ছাড়া সরাসরি ক্যাশ ট্রান্সফার স্কিম চালু করে না। প্রায় সব সময়েই তার লক্ষ্য থাকে প্রান্তিক মানুষের হাতে টাকা পৌঁছে দেওয়া। তাতে কী হয়? অর্থনীতির চাকা সচল থাকে। অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রয়োজনে বেশি টাকা ছাপিয়েও মানুষের হাতে তুলে দেওয়ার পক্ষপাতী।
২. এখনও বুঝতে পারছেন না তো? একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ধরুন আপনার পাড়ার ক্লাব দু’ লক্ষ টাকা সরকারি অনুদান পেয়েছে। রাতারাতি তারা ক্লাবঘরটা পাকা করে ফেলবে, একটা বড়ো টিভি কেনা হবে। ফাংশন হতে পারে – তাতে শিল্পী ভাড়া করা হবে, ফুটবল প্রতিযোগিতা হলে ফিস্ট মাস্ট। আপনি-আমি ভাবতেই পারি ফুর্তি হচ্ছে – টাকাটা কিন্তু বাজারে ঘুরছে। আর অর্থনীতি চাঙ্গা রাখতে তার কোনও বিকল্প নেই।
৩. এবার প্রশ্ন, মেয়েদের হাতেই কেন টাকাটা দেওয়া হচ্ছে? তার কারণ, ঐতিহাসিকভাবে দেখা গিয়েছে যে, মেয়েরা হাতে বাড়তি টাকা পেলে তা সংসারের, বিশেষ করে সন্তানের স্বাস্থ্য-শিক্ষার কাজেই লাগে। ৫০০ টাকা মায়ের হাতে দিলে বাচ্চারা ডিম পাবে, স্কুলে যাওয়া মেয়েটার স্যানিটারি ন্যাপকিন কেনা হবে। তার চেয়েও বড়ো কথা, নিজেদের ছোটখাটো শখ-আহ্লাদের জন্য তাঁরা স্বামীর মুখাপেক্ষী থাকবেন না।
৪. নোটবন্দি, জিএসটি এবং অতিমারিতে সবচেয়ে বিপদে পড়েছেন অসংগঠিত বা ক্ষুদ্র শিল্পের সঙ্গে যুক্ত লাখো লাখো মানুষ। এঁদের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের নিশ্চয়তা নেই একেবারেই। তাই লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্প এই শ্রেণির মহিলাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়াবে, উন্নত হবে তাদের জীবনের মান।