অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ – এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই! ঘরের বাইরে পা রাখতেই সন্দেহ – ওত পেতে আছে ভাইরাসের থাবা। অন্দরমহলের স্বাচ্ছন্দ্যই বা আগের মতো কোথায়? চাকরি নেই অনেকের, যাঁদের আছে, তাঁদেরও কদ্দিন থাকবে জানা নেই। মাইনেতে কোপ পড়েছে, সেই সঙ্গে আছে ঘরবন্দি থাকার মানসিক চাপ। সব মিলিয়ে আমাদের জীবনে এখন একটাই সত্যি, তাই হল অনিশ্চয়তা।
একটা কথা মনে রাখতে হবে, মানুষের মন হল এক অজানা, রহস্যময় দুনিয়া। সেখানে কোনও নিয়মের বাঁধন খাটে না। অতুল বৈভব আর সাফল্যও সুশান্ত সিং রাজপুতের মতো প্রতিভাবান অভিনেতাকে ধরে রাখতে পারল কই? বেঁচে থাকার দৈনন্দিনতার থেকে মুক্তি পেতে তিনি নিজেকেই শেষ করে দিলেন একদিন। সে ধাক্কা গোটা দেশ আজ পর্যন্ত কাটিয়ে উঠতে পারল কই?
খবরের শিরোনামে অতি সস্প্রতি জায়গা করে নিয়েছেন দিল্লির লেডি শ্রীরাম কলেজে উচ্চশিক্ষারত মেধাবী ছাত্রী ঐশ্বর্যা রেড্ডি। তেলেঙ্গানার নিম্নবিত্ত পরিবারের এই রিসার্চ স্কলার বহুদিন তাঁর স্কলারশিপের টাকা পাননি, ছিল না ল্যাপটপ কেনার সামর্থ্য – অনলাইন ক্লাসও করতে পারছিলেন না ঠিকমতো। মোটর মেকানিক বাবা আর দর্জির কাজ করা মা সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন, মেয়ের লেখাপড়ার বিষয়টা ক্রমশ গৌণ হয়ে আসছে – পরিস্থিতি এই দিকে গড়াতে আরম্ভ করায় ঐশ্বর্যা আত্মহননের রাস্তাটাই বেছে নেন।
মহারাষ্ট্রের সরকার অধিগৃহীত পরিবহন দফতর থেকেও আসছে আত্মহত্যার খবর। কর্মীদের বেতন অনিয়মিত, সংসার চালানো দায় হয়ে পড়ছে। ওদিকে সরকারের তরফে দায়ী করা হচ্ছে অতিমারী পরিস্থিতিকে – আয় পুরো বন্ধ বলেই কর্মীদের হাতে পুরো মাইনে তুলে দিতে দেরি হচ্ছে – খাড়া করা হচ্ছে এমন এক সওয়াল।
এমন উদাহরণ আরও অনেক দেওয়া যায়, তাতে মন আরও ভারী হবে ক্রমশ – আর তেমন লাভ নেই। কিন্তু আমরা যারা দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে যাচ্ছি, কিছুতেই মনোবল হারাচ্ছি না এবং আশা করছি এই অন্ধকার কেটে যাবে একদিন, তারা কি কোনওভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারি কারও দিকে? সামাজিক জীব হিসেবে আমাদের কি করণীয় আছে কিছু?
মনোবিদরা বলছেন, অবশ্যই আছে! মনে রাখবেন, মানুষে-মানুষে স্বাভাবিক আদানপ্রদান ক্রমশ কমছে। রাস্তায় বেরোলে যে সব চেনা মুখগুলোকে আমরা দেখতে পেতাম এতদিন, সেগুলো মাস্কে ঢাকা। চেনা মানুষকে অপরিচিত মনে হচ্ছে, কাছের বন্ধুকে বাড়িতে ঢোকাতে দ্বিধা লাগছে। তার উপর আর্থিক অনিশ্চয়তা তো আছেই। এই অবস্থায় যে কেউ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়বেন। যাঁরা অতিরিক্ত মাত্রায় স্ট্রেসের শিকার বা ডিপ্রেশনে ভোগেন, অথবা পরিবারে আত্মহত্যার ইতিহাস আছে তাঁদের এই অবস্থায় বাড়তি সাহায্য চাই।
এখানে আরও একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। আপনি কিন্তু পেশাদার মনোবিদ নয়, কাজেই কারও কাউন্সেলিং করার দায়িত্ব নেবেন না। আর না, মন খুলে কথা বললেই ডিপ্রেশন বা আত্মহননের ইচ্ছে গায়েব হয়ে যায় না ম্যাজিকের মতো। তার জন্য দীর্ঘ কাউন্সেলিং ও ক্লিনিকাল চিকিৎসার প্রয়োজন। তবে কিছু লক্ষণ দেখে বুঝতে পারবেন আপনার পরিচিত কেউ নিজের জীবন সম্পর্কে চরম সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা ভাবছেন কিনা।
কোন কোন লক্ষণ দেখে বোঝা যাবে কেউ আত্মহত্যার কথা ভাবছেন কিনা?
এক, তাঁর কথাবার্তার ধরনে পরিবর্তন আসবে। ঘুরে-ফিরে আসবে মৃত্যুর প্রসঙ্গ, জীবনের অসারতার কথা। অনেকে উইল তৈরি করেন, সব ধার-বাকি মিটিয়ে দেওয়ার কথা বলেন।
দুই, সন্দেহজনক কথাবার্তা শুনলেই তাঁর সাম্প্রতিক অবস্থান সম্পর্কে একটু খোঁজখবর নিন। কিছুদিনের মধ্যে তিনি কি খুব প্রিয় কাউকে হারিয়েছেন? টাকাপয়সার টানাটানি চলছে? দুরারোগ্য অসুখ করেছে? অথবা যে অবস্থায় তিনি আছেন, যে কোনও প্রকারে সেখান থেকে পালাতে চাইছেন? এটা কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সবচেয়ে বড়ো ট্রিগার হয়ে দাঁড়ায়।
তিন, ডিপ্রেশন বা স্ট্রেস থাবা বসায়নি তো? মন খারাপের অসুখ থাকলে কিন্তু আত্মহত্যার ইচ্ছেটা ক্রমশ বাড়তে থাকে। আচমকা যদি ঘুম বা ক্লান্তি বাড়তে থাকে, তা হলেও চিন্তার বিষয়। অনেকে অবশ্য একেবারেই ঘুমোতে পারেন না রাতের পর রাত – তাঁদের চেহারায় তার স্পষ্ট ছাপ পড়ে। কেউ কেউ নেশার অন্ধকার পথে হারিয়ে মনের শান্তি খোঁজেন। প্রতিটিই সন্দেহজনক।
চার, অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের ক্ষেত্রে খুব সাবধান। তারা কি অনলাইন ক্লাসে মানিয়ে নিতে পারছে? দেশ জুড়ে সমস্ত প্রাইভেট স্কুলে পড়ুয়াদের ফি কমানো নিয়ে উত্তাল আন্দোলন হচ্ছে। যে সব বাবা-মা আর্থিক কারণে ফি মেটাতে পারছেন না, বা বাচ্চার জন্য ভালো কোনও গ্যাজেটের ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হয়েছেন, তাঁদের সন্তানের মনের উপর মারাত্মক চাপ পড়ছে। বাচ্চারা কিন্তু মনের কথা চেপে রাখতে না পেরে অনেক হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে।
পাঁচ, আর্থিক স্বাচ্ছল্য বা সামাজিক সাফল্যের খোলসের আড়ালেও লুকিয়ে থাকতে পারে প্রবল দুঃখী মন। যদি বোঝেন কারও সমস্যা হচ্ছে, তা হলে তাঁকে কোনও কিছুর সাপেক্ষে জাজ না করে পাশে দাঁড়ান। কখনও কারও সমস্যাকে ছোটো করে দেখবেন না, তুচ্ছ বলে উড়িয়ে দেবেন না। তাতে এঁদের কষ্ট আরও বাড়ে, কমে না।
ছয়, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হেল্পলাইনের সঙ্গে যোগাযোগ করুন, সাহায্য চান। চেষ্টা করলে একেবারে শেষ সময়েও আত্মহত্যার মুখ থেকে আপনি ফিরিয়ে নিয়ে আসতে পারবেন প্রিয়জনকে।