তলিয়ে না দেখলে স্রেফ একটা দুঃখজনক ঘটনা বলে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যাওয়া যায়। প্রখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার শর্বরী দত্তের হাসি-খুশি, পরিপাটি চেহারাটাই আমরা দেখে এসেছি বরাবর। তাঁর মৃতদেহ আবিষ্কার হল বাড়ির বাথরুমে, বিশ্বকর্মা পুজোর দিন, একা।
এই মৃত্যুর পিছনে কী কারণ ছিল, তা নিয়ে বিস্তর কাটাছেঁড়া হয়েছে – সে আলোচনায় আমরা একেবারেই ঢুকতে চাইছি না। আমাদের ধাক্কা দিয়েছে একেবারে অন্য একটা বিষয়। তাঁর পরিবারে কী সমস্যা ছিল তা না ভেবে বরং নিজেদের দিকটা দেখা যাক একবার।
বয়স হলে শারীরিক কিছু সমস্যা তো হয়ই। আগের মতো স্বচ্ছন্দে ঘোরা-ফেরা করা যায় না, ধীরে ধীরে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে যোগাযোগ কমে আসে। তার পর একে একে তাঁদের সমসাময়িকরা পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে বিদায় নিতে থাকেন, ওদিকে সন্তান ব্যস্ত হয়ে পড়ে নিজের জীবন নিয়ে। ফলে একাকীত্বের বোঝা বাড়ে।
এই পরিস্থিতি হোক, তা কি কোনও সন্তান চায়? কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও ঠিক যে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানেরও খানিক দূরত্ব তৈরি হয়। ফলে সমস্যা আরও ঘোরালো হয়, অভিমান জমতে জমতে পাহাড় হয়ে যায়। অভিভাবকরা নিজেদের খোলসের আরও গভীরে ঢুকে যান।
সন্তানেরও নানা দায়িত্ব থাকে, তার মাঝেও একটু লক্ষ রাখুন বড়োদের ব্যবহারের দিকে। কিছু কিছু লক্ষণের কথা জানিয়েছেন লাইফলাইন ফাউন্ডেশনের অন্যতম ট্রাস্টি ও ‘নিউ লিফ: মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড ওয়েল বিয়িং’-এর সঙ্গে যুক্ত কনসালট্যান্ট সাইকোলজিস্ট শুভিকা সিং। দরকারে হেল্পলাইনের সাহায্য নিন। লাইফলাইনের ফ্রি হেল্পলাইনের নম্বর ০৩৩৪০৪৪৭৪৩৭/ ০৯০৮৮০৩০৩০৩ (সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা লাইন খোলা থাকে)।
১. আপনার সঙ্গে আগে যেভাবে যোগাযোগ রাখতেন, সেটা কি বদলেছে?
কোনও কোনও ক্ষেত্রে মা-বাবা ছোটো ছোটো বিষয় নিয়ে আপনাকে বিরক্ত করতে পারেন বার বার, কখনও আবার মোটেই কথাবার্তা বলবেন না। দুটোই অস্বাভাবিক। মনে রাখবেন, রাতারাতি কেউই একাকীত্বে ভুগতে আরম্ভ করেন না, এটা একটা দীর্ঘ প্রসেস। তবে খেয়াল রাখলে গোড়া থেকেই বুঝতে পারবেন কী হচ্ছে।
২. নিজের শরীর বা স্বাস্থ্য নিয়ে মাথাব্যথা থাকে না
একাকীত্ব সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে, ধীরে ঢীরে হাতের বাইরে বেরিয়ে যায়। তাই যদি দেখেন যে শরীর বা স্বাস্থ্য নিয়ে তাঁদের আগের মতো মাথাব্যথা নেই, ওষুধ খাচ্ছেন না সময়ে — তা হলে সাবধান হোন।
৩. মোটিভেশন নেই, উলটে বাড়ছে নেগেটিভ চিন্তা
সারাক্ষণ নেগেটিভ চিন্তাভারনা করাটা কিন্তু খুব সুবিধের নয়। এর সঙ্গে সাধারণত নড়াচড়া করার ইচ্ছেটাও চলে যায়।
৪. বারবার কোনও ব্যথা বা যন্ত্রণার কথা বলছেন কী?
সেটাও কিন্তু মানসিক সমস্যা থেকে হতে পারে। তবে আগে কথা বলা দরকার, প্রয়োজনে পেশাদারের সাহায্য নিন। না জেনে বুঝে সিদ্ধান্তে পৌঁছবেন না, জাজ করবেন না একেবারেই। ওঁদের মন খুলে কথা বলতে দিন।
এই পরিস্থিতিতে আপনার কী করা উচিত?
• প্রথমত ওঁদের পাশে দাঁড়ান, বুঝিয়ে দিন যে আপনি সাহায্য করতে চান। কথা বলুন, শারীরিকভাবে সচল থাকতে, স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে উৎসাহ দিন।
• দরকারে পেশাদারি সাহায্য নেওয়ার প্রয়োজন বোঝান। মনে রাখবেন, একাকীত্ব বাড়তে বাড়তে ডিপ্রেশনে পৌঁছয়। ডিপ্রেশন থেকে আত্মহত্যার প্রবণতা আসতে পারে। তাই একা ছেড়ে দেবেন না কোনও পরিস্থিতিতেই।
• বাড়ির বাচ্চাদের ওঁদের জিম্মায় খানিক সময় ছেড়ে দিন রোজ, তাতেও মন ভালো থাকবে। ওঁদের কথা বলার, নিজের মত প্রকাশ করার স্বাধীনতা দিন।
যাঁরা মা-বাবার সঙ্গে এক শহরে থাকেন না, তাঁরা কী করবেন?
• প্রথমত, ইমোশনাল কানেকশনটা যেন থাকে, তা দেখবেন। ফোন, মেসেজ, ভিডিও কল – যোগাযোগ রাখার অজস্র উপায় আছে। মা-বাবার কাছ থেকে নানা বিষয়ে পরামর্শ নিন, গুরুত্ব দিন তাঁদের মতামতকে। এটুকু সম্মানেই ওঁদের মন ভালো হয়ে যায়।
• টেকনোলজির কল্যাণে এখন অনেক কিছু সম্ভব – ওনাদের খাবার সময় ভিডিও কল করে দেখুন কী খাচ্ছেন। একসঙ্গে খেতে বসতে পারেন। বাবা-মায়ের দেখভালের জন্য নানা অনলাইন সার্ভিসের সাহায্য নিন।
• একসঙ্গে সবাই মিলে বসে আড্ডা দিতে বা কোনও গেম খেলতে পারলেও খুব ভালো হয়। সেই সঙ্গে খেয়াল রাখুন তাঁদের স্বাস্থ্যের। নিয়মমাফিক চেকআপ যেন হয় – সেই সঙ্গে ডাক্তারের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখুন।