ফেব্রুয়ারির গোড়ার দিকে যখন প্রথম কোভিড প্রবেশ করেছিল ভারতে, তখনও অনেকে আঁচ করতে পারেননি তার পরিণতিটা এরকম হতে চলেছে। মনের মধ্যে একটা বিশ্বাস ছিল, ও কিছু হবে না। মাস গড়াতে না গড়াতে ক্রমশ বাড়তে থাকা সংক্রমণ আর তার পরে টানা লকডাউনে সেই আত্মবিশ্বাস হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল তাসের ঘরের মতো। শুধু যে রোগের আশঙ্কা তা তো নয়, কোভিডের ব্যাপক প্রভাব পড়েছে দেশের অর্থনীতিতে। নানা কোম্পানি থেকে ছাঁটাই হয়েছে একের পর এক, বন্ধ হয়ে গেছে কারখানা, ছোট প্রতিষ্ঠান। ছেলেমেয়েদের স্কুল বন্ধ, বাজারে জিনিসপত্র অগ্নিমূল্য! সব মিলিয়ে ঘরেবাইরে রীতিমতো চাপে সাধারণ মানুষ।
আর এই চাপের অবধারিত ফল বর্তাচ্ছে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর। সামাজিক মেলামেশার ওপর বিধিনিষেধ থাকায় মানুষ একা হয়ে যাচ্ছে। সারাক্ষণ একটা খোলসের মধ্যে থাকতে থাকতে, নানারকম ভয় আর অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকতে থাকতে ডিপ্রেশন দেখা দিচ্ছে, কখনও কখনও তার ফল হচ্ছে মারাত্মক। এই মুহূর্তে আনলক পর্ব চললেও দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা অনিশ্চয়তা এত তাড়াতাড়ি যাওয়ার নয়। ব্যক্তিগত ক্ষেত্রেও নানা অপূর্ণতা থাকে আমাদের সবারই। ফলে ভেতর আর বাইরের অপ্রাপ্তি একসঙ্গে জুটে মেঘ জমছে মনে। এই উৎসবের মরশুমে আরও ঘন হয়ে উঠছে মেঘ। কী করবেন এরকম পরিস্থিতিতে?
এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে আমরা কিন্তু ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশনের কথা বলছি না। ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশন সম্পূর্ণ চিকিৎসাগত বিষয়, এবং তার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
মন খারাপটাকে মেনে নিন। অনেক সময় মন খারাপটাকে আমরা মেনে নিতে পারি না। এটা ওটা করে মন খারাপটাকে ভুলে থাকার চেষ্টা করি। এতে লাভ নেই। সমস্যার অস্তিত্ব মেনে না নিলে তা থেকে মুক্তি পাবেন না। কারণ মেনে নিলে তবেই তার কারণ অনুসন্ধানের পরিসর তৈরি হবে।
মন খারাপের কারণগুলো বোঝার চেষ্টা করুন। নিজের সঙ্গে কথা বলার বিকল্প নেই। আপনার মন কেন খারাপ, তা সবচেয়ে ভালো জানেন আপনিই। নিজেকে জিজ্ঞেস করুন ঠিক কী কী কারণে আপনার মন খারাপ হচ্ছে। নানা কারণে মন খারাপ হতে পারে। তার কোনওটা আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, আবার কোনওটার সরাসরি নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাতে থাকে না। আপনার কেন মন খারাপ হচ্ছে বুঝতে পারলে হয়তো তার সমাধানটাও খুঁজে পাবেন আপনি।
নিয়ন্ত্রণাধীন কারণ:
যে সব কারণ আপনার নিয়ন্ত্রণের মধ্যে, সেগুলো কতটা সামাল দেওয়া সম্ভব সেটা ভেবে বের করতে হবে। যদি পেশাগত কারণ হয়, অর্থাৎ চাকরি চলে গেলে বা মাইনে কাটা গেলে সেই সমস্যাটা একটু চিন্তাভাবনা করে সামলানো সম্ভব। প্রথমত যেখানে যেখানে খরচ কমানো সম্ভব, তা কমিয়ে আনুন। এই বাজারে নতুন চাকরি পাওয়া কঠিন, তাই পুরো সময়ের চাকরি না খুঁজে ফ্রিলান্সার হিসেবে কাজ খুঁজুন। ফাঁকা সময়টায় চেষ্টা করুন পার্ট টাইম কাজ করতে। মাথা ঠান্ডা রেখে লক্ষ্য স্থির করুন, অসময় কেটে যাবে। পারিবারিক সমস্যা থাকলেও সেটা কেন হচ্ছে, বিশ্লেষণ করে বোঝার চেষ্টা করুন।
নিয়ন্ত্রণের বাইরের কারণ:
অনেক সময় একটানা মেঘলা দিন প্রচণ্ড ডিপ্রেশন তৈরি করে। শীতের সন্ধের ছোট হয়ে আসা বেলা অনেকেরই মন খারাপের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। অথবা যাঁরা একটু অন্তর্মুখী বা বেশি বন্ধুবান্ধব নেই, তাঁরা খুব হুল্লোড়ে পরিবেশে মনখারাপে ভুগতে থাকেন। এরকম ক্ষেত্রে আলাদা করে বিশেষ কিছু করার নেই, কারণ এ সব ক’টা কারণই আপনার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তবে পরিবেশের একটু পরিবর্তন করে মনের ওপর রাশ টানার চেষ্টা করতে পারেন। শীতের সন্ধেয় বা মেঘলা দিনে ঘরে বড়ো আলো জ্বালিয়ে রাখুন, গান শুনুন, বই পড়ুন, ভালো খাবার খান। ঘরে উজ্জ্বল রঙের বা সুগন্ধি ফুল রাখলে মন হালকা হয়। অল্প কয়েকজন কাছের মানুষের সঙ্গে দেখা করলে বা ফোনে গল্প করলেও ভালো লাগবে। মোট কথা, নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করুন।
সম্পর্কজনিত কারণ:
প্রেম ভাঙলে, বাড়িতে সারাক্ষণ অশান্তি লেগে থাকলে তার ছাপ মনের ওপর পড়বেই! এ ক্ষেত্রেও পরিস্থিতির ওপর আলাদা করে আপনার নিয়ন্ত্রণ নেই, তবে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখার চেষ্টা করুন। শান্তভাবে নিজের কথাটুকু বলে অশান্তির পরিবেশ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিন। প্রেম ভাঙলে অবশ্য প্রথম কিছু দিন বা কিছু মাস কষ্ট সহ্য করতেই হবে, তবে সময়ের নিয়মে সে কষ্টও একদিন ফিকে হতে বাধ্য! এই সময়টুকু নিজের মনের ওপর রাশ টেনে রাখুন, আবেগের চেয়ে প্রাধান্য দিন যুক্তিকে। এটা আসলে একটা চর্চার ব্যাপার। সচেতনভাবে মাথা থেকে নেগেটিভ চিন্তা সরিয়ে দিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখুন। মন খারাপের মেঘ ধীরে ধীরে কেটে যাবে।