বারো ক্লাসে পড়ে দক্ষিণ-পূর্ব কলকাতার এক অভিজাত আবাসনের বাসিন্দা মেধাবী ছাত্র। মাকে কর্মসূত্রে যেতে হয়েছে অন্য শহরে, বাবা ব্যস্ত থাকেন নিজের কাজে। সারা দিন অনলাইন ক্লাসের চাপ, টিউশন –বাইরে বেরনো বন্ধ। পরীক্ষা এগিয়ে আসতে আরম্ভ করায় ছেলেটির মানসিক অবসাদ বাড়ল – পরিস্থিতি এমন জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালো যে বাথরুমের জানলা দিয়ে লাফিয়ে পড়ে নিজেকে শেষ করে দেওয়াটাই তার সবচেয়ে সহজ বলে মনে হল।
করোনায় আক্রান্ত মা মারা গিয়েছেন, বাবা দীর্ঘদিন ভুগে সুস্থ হয়ে সম্প্রতি কাজে যোগ দিতে গিয়ে জেনেছেন কোম্পানি তাঁকে ছাঁটাই করে দিয়েছে। আত্মীয় স্বজন ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলছে, সামনে তীব্র অনটনের অন্ধকার। ১৪ বছরের ছাত্রী আত্মহত্যা করেছে তাই।
সব খবরগুলোই চেনা, তাই না? কাগজের পাতা ওলটান, টিভির চ্যানেল বদলান, চোখ রাখুন নিউজ পোর্টালের পাতায় – এমন অজস্র ছোট ছোট খবরের খোঁজ পাবেন। এক একদিন গোটা রাজ্যে জনা সাত-আট বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়ে আত্মহত্যা করেছে, এমন নজিরও আছে। শহরের স্কুলগুলিও একটা ব্যাপারে নিঃসন্দেহ – কম-বেশি সব ছাত্র-ছাত্রীই মানসিক চাপের শিকার। তবে সেটা ডিপ্রেশনে পর্যবসিত হচ্ছে কিনা, তা দেখার দায় অবশ্যই বাড়ির লোকের।
কাকে বলে ডিপ্রেশন?
অবস্থা বিশেষে আমাদের সকলেরই অল্পবিস্তর মন খারাপ হয়। আবার সেটা কেটেও যায় কিছুদিন পর। ডিপ্রেশনের ব্যাপারটা কিন্তু তা না। দুঃখ, হেরে যাওয়া, অবসাদের বোধটা থাকে মাসের পর মাস – রোজের স্বাভাবিক কাজকর্মে তা ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। সঙ্গে থাকে ক্লান্তিবোধ, বিরক্তি, মাথাব্যথা, ইনসমনিয়ার মতো নানা সমস্যা। বড়োরা তাও বুঝতে পারেন কোনও সমস্যা হলে, বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়েরা খেই হারিয়ে ফেলে একবার ডিপ্রেশনের কবলে পড়লে।
পরিসংখ্যান কী বলছে
যদি আমরা সংখ্যার নিরিখে বিচার করতে বসি, তা হলে দেখা যাবে, ভারত পৃথিবীর সবচেয়ে আত্মহত্যাপ্রবণ দেশগুলির অন্যতম এবং এদেশে ১৫-৩০ বছর বয়সিদের মধ্যে সুইসাইডের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। অতিমারি পরিস্থিতিতে কাজ হারিয়ে রোজগার কমে গিয়েছে বহু মানুষের। প্রতিদিন খবরের কাগজের শিরোনামে উঠে আসে নামী-দামি স্কুলের কথা।
অভিভাবকেরা ফি দিতে না পারায় অনলাইন ক্লাস থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে পড়ুয়াকে। অনলাইন লেখাপড়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না অনেক ছাত্রছাত্রী, কারও কাছে ডিভাইস নেই তো কেউ ইন্টারনেটের খরচ সামলাতে পারছে না। এতদিন যারা প্রাইভেট টিউশনের উপর ভর করে পড়াশোনা চালিয়ে এসেছে, তাদের সমস্যা আরও গভীর – স্কুলের মাইনে ঠিকমতো দিতে পারছেন না অভিভাবক, ব্যক্তিগত শিক্ষক রাখার তো প্রশ্নই ওঠে না!
ফলে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে, বহু ছাত্রছাত্রী ভয়ানক মানসিক চাপের শিকার। খেলাধুলো নেই, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া নেই, অতিমারির আতঙ্ক, আর্থিক সমস্যা, সেই সঙ্গে লেখাপড়ায় পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা – সব মিলিয়ে তাদের স্ট্রেস মারাত্মক। তাই আপনার সন্তান বা পরিচিত কোনও টিনএজারের দিকে সতর্ক নজর রাখুন, বোঝার চেষ্টা করুন তাদের কোনও সমস্যা হচ্ছে কিনা।‘
কীভাবে বুঝবেন কেউ মানসিক চাপের শিকার কিনা
• দীর্ঘদিন তার মন খারাপ থাকবে, মেজাজ খিঁচড়ে থাকতে পারে। হয় কথাই বলবে না, বা অহেতুক তর্ক করবে সবার সঙ্গে।
• কোনও কাজেই তার ইন্টারেস্ট থাকবে না। যে ক্রিকেট খেলত বা গান গাইতে ভালোবাসত, সেও শতহস্ত দূরে পালাবে সে সব থেকে। ঘরদোর অগোছালো পড়ে থাকবে, স্নান করা, পরিষ্কার জামাকাপড় পরার ব্যাপারেও আগ্রহের অভাব দেখবেন।
• কারও সঙ্গে সময় কাটাতে ভালো লাগবে না তার। সারাক্ষণ একা একা থাকা, আত্মহত্যার কথা বলা বা নিজেকে আঘাত করার প্রবণতাও চোখে পড়বে।
এই পরিস্থিতি থেকে বেরনোর উপায় কী
আপনাকে কাউন্সলিংয়ের সাহায্য নিতে হবে। এমন কারও কাছে বাচ্চাকে নিয়ে যেতে হবে, যাঁর কাছে সে মন খুলে কথা বলতে পারবে। সেটা যে একেবারে প্রথমেই হবে, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। দরকারে থেরাপিস্ট বদলাতে হতে পারে। কিন্তু তার আগে সন্তানের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে হবে। সম্ভব হলে বাচ্চার সঙ্গে একেবারে গোড়া থেকেই সুসম্পর্ক বজায় রাখুন। ছোটো থেকেই তার সুবিধে-অসুবিধে শুনুন, তাকে নিজের সমস্যার কথা বলুন। অভিভাবকরা যতটা বোঝেন, বাচ্চারা তার চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধিমান হয়। অভিভাবকের সময় আর সহমর্মিতা তার সবচেয়ে আগে প্রয়োজন।
তবে এ সব পেলেও কিন্তু যে কোনও মানুষের ডিপ্রেশন হতে পারে। মনে রাখবেন, শরীরের মতোই মনেরও অসুখ হয়। আপনি সুস্থ থাকার চেষ্টা করার পরেও জ্বর সর্দি-কাশিতে ভোগেন তো? মাঝে মাঝে বড়ো অসুখও হয়, আবার কিছু কিছু রোগ পারিবারিকভাবেই বিব্রত করে – তাই না? মনের সমস্যাও ঠিক তেমনই। সন্তানের ডিপ্রেশন হলেই ভেঙে পড়বেন না, তার পাশে দাঁড়ান।