নেশা একটি শারীরিক ও মানসিক প্রক্রিয়া। মানুষ যখন কোনও উত্তেজকের আবেশে নিজের উপর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে, তখন তাকে নেশাগ্রস্ত বলা চলে। কোনও কোনও সময়ে বিশেষ কোনও কাজের প্রতিও এমন আকর্ষণ দেখা দেয়। নেশায় আচ্ছন্ন মানুষ বুঝতে পারে যে এর ফলে তার শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি হচ্ছে, কিন্তু বেরিয়ে আসতে পারে না তার মায়া কাটিয়ে।
স্রেফ সিগারেট, মদ, হেরোইন, কোকেন বা ঘুমের ওষুধ খেয়েই যে মানুষ নেশা করে তা নয় – জুয়া বা ভিডিও গেম খেলা, অতিরিক্ত খাওয়া, শপিং করা – সবই নেশা হতে পারে। নেশার মাত্রা বাড়লে রোজের জীবনযাত্রা ব্যাহত হতে বাধ্য । কিন্তু তার গ্রাস থেকে বেরিয়ে আসা কখনওই খুব সহজ হয় না।
এখানে একটা কথা বলে রাখা দরকার, ইংরেজিতে দুটো আলাদা শব্দ ব্যবহার হয়। যে কোনও নেশা নিয়ে কথা বলতে গেলে সে দু’টি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকা উচিত। এক নম্বর ‘অ্যাডিকশন’ অর্থাৎ আসক্তি, আর দুই হচ্ছে মিসইউজ, অর্থাৎ মাত্রাতিরিক্ত সেবন।
ধরুন, আপনি এমন কাউকে চেনেন, যিনি পার্টিতে গেলেই মদ্যপান করে বেসামাল হয়ে যান এবং তার পর জড়িয়ে পড়েন ঝগড়া, মারামারিতে। ইনি কিন্তু অ্যালকোহল মিসইউজ করছেন। কিন্তু রোজ সন্ধে হলেই যিনি মদের বোতল খুলে বসে পড়েন এবং খানিকটা না খেলে স্থির থাকতে পারেন না, তিনি হলেন অ্যাডিক্ট। মাঝে মধ্যে বেশি মাত্রায় সিগারেট বা মদ খাওয়ার অভ্যেস থেকেই কিন্তু পরবর্তীকালে আসক্তি হতে পারে। আসক্তি হচ্ছে অভ্যেস, চট করে সে রুটিন বদলানো যায় না।
পরিচিত কোনও মানুষ কোনও নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ছেন কিনা, তা বোঝার কতগুলো লক্ষণ আছে। যাঁদের পরিবারে স্কুলের উঁচু ক্লাসে পড়া বা কলেজপড়ুয়া ছাত্রছাত্রী আছে, তাঁরা সতর্ক নজর রাখুন। খবরের দিকে চোখ রাখলেই জানতে পারবেন, যে কোনও রাজ্যের বড়ো স্কুল-কলেজের সামনেই ড্রাগ পেডলারদের আড্ডা থাকে। আর ভিডিও গেমে মাত্রাতিরিক্ত আসক্তির ঘটনা তো নিত্যদিন ঘটছে। তাই বিপদে গলা পর্যন্ত ডোবার আগে সাবধান হোন।
প্রথম পরিবর্তনটা ধরা পড়বে ব্যবহারে। সামান্য সিগারেটের আসক্তি তৈরি হলেই মানুষ আড়াল খোঁজে সুখটান দেওয়ার জন্য। মদের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তাই হয়। অনেক বেশি মাত্রায় ব্যবহারিক পরিবর্তন দেখা দেয় ড্রাগ বা কোনও রাসায়নিক নেশা বা ভিডিও গেম-জুয়ার ক্ষেত্রে। মিথ্যে বলা বা আড়াল খোঁজার পাশাপাশি দেখা দেয় মনঃসংযোগের সমস্যা। ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়ার রেজাল্ট খারাপ হতে আরম্ভ করে।
নেশায় আসক্ত হলে চেহারা ক্রমশ খারাপ হতে থাকে, নিজের দিকে নজর দেওয়ার সময় থাকে না মানুষের। সেই সঙ্গে নেশার ঘোরে তারা অনেক সময়েই এমন কিছু করে ফেলে যা হয়তো স্বাভাবিক অবস্থায় করত না। অনেক ক্ষেত্রে গায়ে-হাতে চোট দেখতে পাবেন, যার কোনও যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা মিলবে না। ধীরে ধীরে চেনা মানুষটা আপনার চোখের সামনে অচেনা হতে আরম্ভ করবে।
পরীক্ষায় খারাপ ফল, চাকরি ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা, সম্পর্কের টানাপোড়েন কিন্তু আসক্তির ক্ষেত্রে ট্রিগার হিসেবে কাজ করতে পারে। এখন কোভিড ও রিসেশনের কারণে এর প্রত্যেকটির আশঙ্কাই অনেকগুণ বেড়ে গিয়েছে। তাই বাড়ছে অ্যাডিকশনও। অসহায় অবস্থায় মানুষ আশ্রয় খোঁজে। সেটা কোনও মানুষের কাছে না পেলে সাবস্ট্যান্স অ্যাবিউসের দিকেই যেতে পারে মানুষ।
সমস্যা হচ্ছে, চট করে কোনও অ্যাডিক্ট চিকিৎসা করাতে রাজি হয় না। জোরজার করে তেমন ফল পাবেন না, আপনাকে তার বিশ্বাস অর্জন করতে হবে, প্রতি মুহূর্তে পাশে থাকতে হবে। ডাক্তার ও কাউন্সেলারের সাহায্য নিন। সামাজিক বদনামের ভয় পাবেন না, প্রিয়জনের পাশে থাকুন। অ্যাডিকশন কাটাতে অনেকদিন সময় লাগে – রাতারাতি ফলের আশা না করলেই ভালো করবেন।