উপদেশ আর ধমকের ভয়ে ট্রেনের টিকিট কাটার আগ পর্যন্ত কাউকে ঘুণাক্ষরেও বলিনি। কোভিড স্পেশাল নামে পদাতিক রোজই ছাড়ছে জেনে টিকিটের স্টেটাস চেক করতে গিয়ে তো হাতে যেন চাঁদ পেলাম। এত কম সময়ের ব্যবধানে উত্তরবঙ্গের টিকিট! সরকারি তরফে ট্যুরিজম খুলে দিয়েছে উত্তরবঙ্গে ৬ সেপ্টেম্বর। অতএব মূহূর্তের সিদ্ধান্তে টিকিট কেটে ফেললাম।
কিন্তু কোথায় যাব? যেতে হবে এমন কোথাও যেটা শহরাঞ্চলের বাইরে, মানে যেখানে কোভিডের প্রকোপ কম। পছন্দসই জায়গার হোম-স্টেগুলোর সাথে কথাবার্তা বলে জানতে পারলাম যে ১৫ অক্টোবরের আগে কোনও হোমস্টেই খুলছে না। কারণ গ্রামের মানুষের আপত্তি। তবে হোটেল মোটামুটি খুলে গেছে।
খুঁজে-পেতে পছন্দ হল হোটেল লামাহাটা রেসিডেন্সি। দার্জিলিংয়ের আগে জোড়বাংলো থেকে ডানদিকে কালিম্পংয়ের রাস্তায় গড়ে উঠেছে এক ছোট্ট পর্যটন কেন্দ্র, লামাহাটা।
করোনাকালে বেড়াতে যাচ্ছি, তাই যাত্রাপথের প্রস্তুতি হিসেবে সঙ্গে নিলাম:
১. ট্রেনের জন্য: গায়ে দেবার চাদর, এয়ার পিলো। (ট্রেনে এসিতেও এখন বালিশ চাদর দেওয়া হচ্ছে না)
২. কয়েক টুকরো কাপড়। (ট্রেনের সিট স্প্রে দিয়ে স্যানিটাইজ করে কাপড় দিয়ে পুরোটা মুছে পরিষ্কার করার জন্য)
৩. বেশ কিছু বড়ো আকারের পলি-প্যাক, ট্রেনে পরা পোশাক আলাদা রাখার জন্য। জামাকাপড় কাচার প্রশ্ন নেই কারণ বর্ষাকাল, কিচ্ছু শুকোবে না তিন দিনেও।
৪. ট্রেনের জন্য জল, রাতের খাবার, শুকনো খাবার ইত্যাদি।
৫. সার্জিকাল মাস্ক, মাথা-ঢাকা, এবং স্যানিটাইজার।
নিউ নরমালে যাত্রা হল শুরু
যথাসময়ে পৌঁছে গেলাম শিয়ালদা স্টেশনে। গিয়েই যেন ধাক্কা খেলাম একটা। এত ফাঁকা স্টেশন চত্বর! ভিতরে ঢোকার সিঁড়ির সামনে অনেকটা জায়গা জুড়ে বাঁশের ব্যারিকেড করা, আর রেল পুলিশের পাহারা। বিনা টিকিটে প্রবেশ নিষেধ। যেন যুদ্ধকালীন সতর্কতা।
ট্রেনে উঠে অবশ্য খারাপ লাগাটা খানিক কমল। যাত্রীরা সকলেই সাবধানী, মাস্ক পরা, যে যার সিট স্যানিটাইজ করতে ব্যস্ত। আর আমাদের বগিটা টু-টায়ার হওয়ায়, দূরত্ববিধি মোটামুটি মানা গেল।
সব কিছু ধুলিস্যাৎ হয়ে গেল এন জে পি পৌঁছে। স্টেশনের বাইরেই ট্যাক্সিচালকদের ভিড়, পারলে হাত ধরে টেনে নিয়ে যায়। তার উপর নামল বৃষ্টি। ব্যস! সোনায় সোহাগা। সবাই উঠে পড়ল স্টেশন চত্বরে। যাত্রী, ট্যাক্সিচালক সবাই গা ঘেঁষাঘেঁষি।
হোটেলের পাঠানো গাড়িতে ওঠার আগে আর এক প্রস্থ নিজেদের স্প্রে করে, গাড়ির সিট স্প্রে করে, মাস্ক পালটে নতুন মাস্ক পরে রওনা দিলাম।
গন্তব্যে পৌঁছনোর পর
বৃষ্টি মাথায় নিয়ে পৌঁছলাম লামাহাটা। সেখানে অবশ্য চিত্রটা পুরো অন্যরকম। প্রথম দিন আমাদের জন্য সবাই মোটামুটি মাস্ক পরে ছিল, কিন্তু লক্ষ্য করলাম নিজেদের মধ্যে কেউই মাস্ক পরছে না। কারণ ওখানে করোনা নেই বললেই চলে।
লাঞ্চের পর ক্যামেরা কাঁধে হাঁটতে বেরিয়ে পড়লাম, পিচ রাস্তা ধরে। রাস্তার একদিকে উঠে গেছে পাহাড়, লাইন নিয়ে আকাশ ছোঁয়া সবুজ পাইন গাছের সারি সমেত আর সেই সবুজে রং ধরাতে যেন নিচের দিকে অসংখ্য রঙিন ফুলের মেলা। বাকিটা যাঁরা পাহাড়ে বেড়াতে যান, আন্দাজ করতে পারছেন।
দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনের সকাল আমাদের উপহারের ঝোলা পূর্ণ করে দিল সপারিষদ কাঞ্চণজঙ্ঘা দর্শন দিয়ে। হোটেলের জানালার সামনে বসেই বোধ হয় সারা দিন কাটানো যায়।
তিন দিনের ভ্রমণে এক ফাঁকে দার্জিলিংও ছুঁয়ে এলাম। ভিড় কম, ট্যুরিস্ট হাতে গোনা, দোকান অধিকাংশই বন্ধ। ম্যালে লোকজন আছে তবে অপেক্ষাকৃত কম। সব দোকানেই স্যানিটাইজার রাখা আছে। মুখবন্ধনী সবাই মানছে দার্জিলিংয়ে।
দুটো অসুবিধের মুখে পড়লাম এবারের ভ্রমণে:
১. স্টেশনের রিটায়ারিং রুম বন্ধ। অতএব পাহাড় থেকে বিকেলবেলা নেমে, ট্রেনের অপেক্ষায় তিন-চার ঘন্টা বসে থাকতে গেলে কোনও ভদ্র-সভ্য টয়লেট নেই, যদিও শিলিগুড়ি স্টেশনে বহু স্টল খোলা।
২. শিয়ালদা বা এনজেপি, দু জায়গাতেই ঢোকার সময় কড়াকড়ি, বেরনোর সময় পারলে ঠেলে বের করে দেয়, গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতেও দেয় না। আর বাইরে বেরনো মানেই ট্যাক্সিওয়ালাদের ভিড়। এরা কোভিডের হাত থেকে মানুষকে বাঁচাতে চাইছে, নাকি স্টেশন চত্বরটাকে, কে জানে!
যা মনে থাকবে বহুদিন:
সমস্ত মন্দ লাগা, কোভিডের দুশ্চিন্তাকে ছাপিয়ে গেছে ভালো লাগার অনুভূতি, যার অনেকটা কৃতিত্ব হোটেলের মানুষগুলোর। এই মূহূর্তে কর্মচারীবিহীন হোটেল চালাচ্ছে পরিবারের লোকজন মিলে।
এঁদের আতিথেয়তাও সেই হোমস্টের মতোই। আর সর্ব শেষ ভালো মূহূর্ত উপলব্ধি করলাম যখন সহযাত্রী মেয়েটি নির্দ্বিধায় তার চকোলেট ধরা হাতটা বাড়িয়ে দিল, ঠিক আগে যেমনটা হত!
লেখা ও ছবি: তানিয়া দত্ত ঘোষ