আমাদের মস্তিষ্ক এমনভাবেই প্রোগ্রামড হয়েছে যে, লেখাপড়া শেষ করে চাকরি পাওয়াটাকেই আমরা জীবনের মোক্ষ বলে ধরে নিই। আর সেখানেই ধীরে ধীরে বেশ বড়োমাপের একটা প্রশ্নচিহ্ন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স যেভাবে প্রযুক্তির দুনিয়াকে কবজা করে নিচ্ছে, তাতে অনেকেই নিঃসন্দেহ যে আগামী দিনে কাজের বাজারে তা প্রভাব ফেলবে, ফলে বহু মানুষ চাকরি হারাবেন। মানুষের বদলে মেশিন দিয়েই কাজ চলবে।
এই আশঙ্কাটা কতদূর সত্যি? আগে খুব সহজ কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যাক। উন্নতমানের মেশিন, যা মানুষ বা পশুর কায়িক শ্রমের ভার লাঘব করে দিতে পারে – আবিষ্কার হয়েছে কতদিন আগে বলুন তো? ঊনবিংশ শতকে? ট্রেন এসেছে, গাড়ির ব্যবহার বেড়েছে। কারখানায় মেশিনের ব্যবহার চালু হয়েছে। তাতে কিছু মানুষ কাজ হারিয়েছেন হয়তো, কিন্তু বহু বহু নতুন পেশাও তৈরি হয়েছে – তাই না?
একটা সময়ে পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষই চাষ-বাসের কাজ করতেন। পশুপালন বা কাপড় বোনা, ব্যবসা করা ছিল সহায়ক ক্ষেত্র। এখন কত মানুষ চাষের কাজের সঙ্গে যুক্ত? সারা দুনিয়ার হিসেব করলে দেখা যায়, জনসংখ্যার মাত্র ৭-৮ শতাংশ মানুষ সরাসরি মাঠে কাজ করেন। তাতে তো বিপুলা পৃথিবীর অজস্র মানুষের খাবারের অভাব হচ্ছে না? কাজের অভাবে মানুষ চাষের ক্ষেতেও ফিরছে না!
তার মানে, উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে নতুন ধরনের কাজের সুযোগও তৈরি হয়, সেটাই নিয়ম। তাই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স মানুষের কাজ কেড়ে নেবে, এমন একটা অতি সরলীকৃত ধারণা আঁকড়ে বসে থাকার কোনও মানেই নেই! কায়িক শ্রমের ভার লাঘব করেছে মেশিন, তেমনই কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রযুক্তিও আপনার সহজ কিছু চাহিদার জোগান দেবে।
এবার প্রশ্ন, তা হলে এলন মাস্ক, স্টিফেন হকিং, বিল গেটসরা কেন আশঙ্কা করেছেন যে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স একদিন মানবসভ্যতার সঙ্কট ডেকে আনবে? উত্তরটা হচ্ছে, ওঁরা যে ধরনের কৃত্রিম মেধার কথা বলেছেন, তা হয়তো বহুদূর ভবিষ্যতে কখনও আবিষ্কার হবে এবং সত্যিই মানুষের বুদ্ধিকে ছাপিয়ে যাবে। কিন্তু আপাতত যা আবিষ্কার হয়েছে, তাতে মানুষই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের নিয়ন্ত্রক। তাই অনর্থক চিন্তা করার কোনও কারণ নেই।
মেশিন কি সত্যিই মানুষকে ছাপিয়ে যাওয়ার শক্তি রাখে?
এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে জানা দরকার মানুষের মস্তিষ্ক কীভাবে কাজ করে। যে কোনও পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে মানুষের ব্রেন দুটো কাজ করে – ১. পর্যবেক্ষণ ও বিবেচনা ২. সিদ্ধান্ত নেওয়া।
একটা সহজ উদাহরণ দেওয়া যাক –আপনি ট্রেনে শিয়ালদহ থেকে বর্ধমান যাবেন, ভাড়া ৩০ টাকা। একটি মেশিনে সেই টাকা জমা করলেন, মেশিন আপনাকে টিকিট ধরিয়ে দিল। এই কাজটা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স দিয়ে হতে পারে। বা আপনার বাড়ি পাহারা দেওয়ার কাজে নিয়োজিত হতে পারে অত্যাধুনিক সিকিউরিটি সিস্টেম।
মানুষ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অনেক ভাবনাচিন্তা করে, সব পরিস্থিতিতে সবাই একরকম সিদ্ধান্ত নেয় না। নানা কারণে সিদ্ধান্ত প্রভাবিত হতে পারে – এত জটিলতা মেনে চলার উপযোগী মেশিন বাজারে আসতে এখনও ঢের দেরি আছে!
এখনও পর্যন্ত বাজারে যে ধরনের অ্যালগরিদম আছে, তার পক্ষে অন্তত এই দুরূহ ধাঁধা ভেদ করা সম্ভব নয়। বড়োজোর ‘অ্যালেক্সা’, ‘সিরি’ বা ‘বিক্সবি’ আপনার আদেশ মেনে কিছু দুঃখের গান শোনাবে, পছন্দের সিনেমা চালাবে – মুড বুঝে কথোপকথন চালাতে পারবে না। তবে যে সব কাজে সিদ্ধান্ত নিতে হয় না, সেখানে মেশিনের ব্যবহার বাড়বে।
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কার্যকর করে তোলার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে ডেটা। তাই আগামীদিনে ডেটা অপারেটর এবং ডেটা সায়েন্টিস্টের কদর বাড়বে। সম্ভবত ডেটা ব্যাঙ্ক তৈরি হবে – তা সামলাতে একেবারে নতুন রকম ব্যাঙ্কিং প্রথা চালু হতেও পারে। বাড়বে ডেটা চুরির আশঙ্কা। কৃত্রিম মেধাকে ডেটা ব্যবহারের কৌশল শেখানোর কাজটা কিন্তু মানুষই করবে – তাই অযথা ভয় পাবেন না!
সব শেষে আরও একটা প্রসঙ্গ উত্থাপন করা দরকার – মানুষ যে কোনও আবিষ্কারকেই ভালো-মন্দ দু’ভাবে ব্যবহার করতে পারে। আণবিক শক্তিই তো তার উদাহরণ! তাই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সম্পর্কেও নিশ্চিত হয়ে কিছু বলা যায় না – সেটাও নির্ভর করবে আমাদের উদ্দেশ্যের উপর!